আব্দুর রাজ্জাক ॥ আট বছর আগে মা ফুলবুরু বেওয়া মারা যাওয়ার পর তাঁর কবর দেওয়া হয়েছিল বসতভিটার পাশে। এখন মায়ের কবরের দ্বোরগোড়ায় আগ্রাসী পদ্মা। নিজের পরিবার ও ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও নিতে পারছেন না মায়ের কবরটি। মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা সেই কবরটি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে, চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে বিষাদে ভরে ওঠছে বুকটা। কবরের পাশেই সারাটি দিন কেঁদে পার করেন হাশেম আলী ও তাঁর ছোট মেয়ে রওশনা আক্তার। পাশেই চলছে ঘরবাড়ি ভাঙাচোরার খেলা।
মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে হাশেম আলীর সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন পদ্মার ঢেউ আছড়ে পরছে সজোরে, পাকা কবরের অর্ধেক অংশ ঝুলে আছে নদীতে। একেকটি ঢেউ যেন আঘাত হানছে হাশেম আলীর অন্তরে। কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এরপর হঠাত দৌড়ে গেলেন তার মায়ের কবরের পাশে। শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখলেন। মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল কবরটি পদ্মার অতল গহ্বরে। সেই সাথে চিরতরে হারিয়ে গেল হাশেম আলীর সবচেয়ে আপন মমতাময়ী মায়ের শেষ স্মৃতিটুকু। বিলাপ করতে লাগলেন, একটু আগে এইখানে ছিল মায়ের কবর; পদ্মার ফেনিল ঢেউয়ের পানে ইশারা করে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, আমার সব শেষ হইয়া গেলো রে, সব গেলো।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর এলাকায় হাশেম আলীর বসতি প্রায় তিন যুগের। বছর তিনেক ধরে উত্তাল পদ্মার আগ্রাসী ভাঙন সেই গ্রামের দুই শতাধিক বাড়ি, বাজার ও রাস্তা শেষ করে দিয়েছে। এখন তাঁর বাড়ির পাশে এসে উঁকি দিচ্ছে পদ্মার ভয়ংকর ঢেউয়ের জল।
পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী রাশিদা বেগম বলেন, ‘এই গ্রাম ভাঙব কহনও ভাবতে পারি নাই, এই গ্রামের আগে আরেক গ্রাম আছিল, তা ভাইঙা গেছে। কম কইরা হইলেও এক’শ পরিবার গ্যাছে। এইব্যার ভাঙন আরো বেশি মনে হইত্যাছে। অনেক বাড়ি-ঘর চইল্যা গেছে নদীতে।
শুধুই হাশেম আলী আর রাশেদা বেগমই নয় এই ইউনিয়নের বেদ্দকান্দি, মোহম্মদপুর, শুদ্রকান্দি এলাকার কৃষক আলাল ফকির, তোতা মিয়া, ইউসুব আলী ভুইয়া ও শের আলীর বাড়ি ঘর সব কিছুই চলে গেছে পদ্মার পেটে। শের আলী জানালেন, বাড়ি ঘর হারিয়ে সে পাশ্ববর্তী ইউনিয়র বাল্লা এলাকায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব বিধ্বস্ত জনপদের সব মানুষের অনাহারি শীর্ণ মুখ। ভিটে নেই, শুধু ধ্বংস্তুপ। আর এমন চিত্র প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ফিরে এলেও ভাঙন রোধে নেই কোনো কার্যকরী উদ্যোগ।
মানিকগঞ্জের পদ্মা যমুনা ও কালিগঙ্গার তীরবর্তী উপজেলা দৌলতপুর, ঘিওর, হরিরামপুর এবং শিবালয় এলাকায় ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গনের ফলে শতশত একর ফসলী জমি, গাছ পালা ও বাড়ি ঘর নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। হুমকির মুখে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,হাটবাজার ও আশ্রয়ন প্রকল্প। অথচ ভাঙ্গন ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অভিযোগ।
হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, স্বামী পরিত্যক্ত আমেনা বেগমের মাথা গোজার ঠাই টুকু দুই দিন আগে পদ্মায় গিলে খেয়েছে। পরিবারের ছেলে,ছেলের বৌ নিয়ে এখন রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়েছে হতদরিদ্র এই অসহায় মানুষ গুলো। রাতারাতি পদ্মায় গ্রাস নেয়া আমেনার পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই গ্রামের ৬০ বছরের আম্বেয়া বেগমের বাড়িটিও পদ্মার পেটে চলে যাওয়ায় এখন অন্যর জমিনে কোন রকম কুড়ে ঘর তুলে বাসবাস করছেন। জানালেন, পদ্মা আমাগো সব শেষ করে দিয়েছে। মাথার ছাউনিটাও দুই দিন আগে রাক্ষুসে নদী গিলে খাইছে।
কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস গাজী বলেন, আমার ইউনিয়নটি পদ্মায় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এখন মানুষ জনের বসতি অনেক কমে গেছে। একসময় ১৩টি মৌজা নিয়ে এই ইউনিয়নের সীমা ছিল । কিন্ত এখন একটি মৌজায় চলে এসেছে। বাকি ১২টি মৌজার সব টুকু নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় নদী ভাঙ্গন রোধে প্রকল্ল তৈরি করে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্ধ হলেও কাজ শুরু করা হবে।
মানিকগঞ্জ২৪/ হা.ফ/ ১২ সেপ্টেম্বর/ ২০১৭।