এস.কে.এম. হেদায়েত উল্লাহঃ
সুব্রত দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় ভুগছে।সবসময়ই দুশ্চিন্তামগ্ন থাকে, হতাশায় ভূগে,মাথা প্রায় সময়ই ব্যথা করে।অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে,অনেক ওষুধ খেয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয়নি।একদিন সে শুনল ঢাকাতে খুব ভালো একজন ডাক্তার আছে।সে অনেক আশা নিয়ে সেই ডাক্তারের কাছে গেলো।ডাক্তার খুব মনোযোগ দিয়ে তার সমস্যার কথা শুনল।এরপর পাশের রুম থেকে একটা ক্যাপস্যুলের কৌটা এনে দিলো।ওষুধটি কিছুদিন খাবার পরে সুব্রত সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে ওঠলো।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়ে হচ্ছে সেই ক্যাপস্যুলে কোন ওষুধ ছিল না,ছিল শুধু চিনি।বিষয়টা অবিশ্বাস্য না? ওষুধ দিয়েও কাজ হলো না অথচ চিনি রোগ সারিয়ে দিলো! সত্যিই এমনটি হয়। আর একেই বলে প্লাসিবো ইফেক্ট।যা শুধুমাত্র মানসিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে রোগ সারিয়ে ফেলে।চলুন প্লাসিবো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
স্কটিশ চিকিৎসক ও ফার্মাকোলজিস্ট উইলিয়াম কোলেন (১৭১০-১৭৯০) সর্বপ্রথম “প্লাসিবো” শব্দটি ব্যবহার করেন।তাই,তাকে প্লাসিবোর জনক বলেন।তবে অনেকেই ইংরেজ চিকিৎসক আলেকজান্ডার সাদারল্যান্ডকেও এ কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন।”প্লাসিবো(placebo)” ল্যাটিন শব্দ যার মানে “shall please”।এটি আরেক ল্যাটিন শব্দ “placeo” থেকে এসেছে যার মানে “I please”.এ থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে ব্যাপারটা সন্তুষ্টির সাথে জড়িত।অর্থাৎ শুধুমাত্র মানসিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে তা কাজ করে।
পারকিনসন ডিজিজ, বিষন্নতা,হতাশা,মাথাব্যথাসহ বিভিন্ন রোগে প্লাসিবোর ব্যবহার নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন।কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা যাচ্ছে।এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে প্লাসিবো প্রচলিত ওষুধের চেয়েও ভালো কাজ করছে।আমরা আমাদের চারপাশে যে অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন,হোমিওপ্যাথি,ইউনানী,রেইকি,আকুপাংচার,হিজামা,রুকাইয়া,মেডিটেশন,পানিপড়া ইত্যাদি পুরোটাই প্লাসিবো নির্ভর বলে গবেষকরা মনে করেন।প্লাসিবো কিন্তু সব রোগে কাজ করে না।নিউরোবায়োলজিক্যাল কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে কাজ করলেও আলসার,ক্যান্সার,এইচআইভির মতো রোগের ক্ষেত্রে প্লাসিবোর বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই।
বিজ্ঞান প্লাসিবোকে কীভাবে দেখে?
প্লাসিবোর কাজের পেছনেও কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।এমেরান মেয়ার,জোহানা জারকো এবং ম্যাট লিবারম্যান প্লাসিবো চিকিৎসা নেয়া মানুষের “ব্রেইন ইমেজিং” করে দেখেছেন যে প্লাসিবো মস্তিষ্কের গঠনে লক্ষ্য করার মতো পরিবর্তন আনে।প্লাসিবো শরীরের গাঠনিক বেশকিছু পরিবর্তন যেমন,হ্নদস্পন্দন,রক্তচাপ ও মস্তিষ্কের রাসায়নিক কার্যক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনে।
পরবর্তীতে গবেষকরা দেখেন যে,প্লাসিবো প্রয়োগের পর মানবদেহে কিছু হরমোন,এন্ডোক্যানাবিনয়েডস,এন্ডোজেনাস ওপিওয়েডসের মতো রাসায়নিক পদার্থ তৈরী হয়।এই রাসায়নিকগুলোই মূলত প্লাসিবো প্রয়োগের পর চিকিৎসায় ভূমিকা রাখে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। তবে প্লাসিবো এখনো বিজ্ঞানের এক অমীমাংসিত রহস্য।
মহামতি প্লেটো বলেছিলেন,”ডাক্তারদের সবচেয়ে বড় ভুল এটাই যে,তারা মনের চিকিৎসা না করেই শরীরের চিকিৎসা করে।” টই কথা থেকেই হয়তো পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা সাইকোমেডিসিন (যা একই সাথে শরীর ও মনের চিকিৎসা করবে) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।তবে এ বিষয়ে খুব একটা অগ্রসর হওয়া যায়নি।তবে প্লাসিবো ইফেক্ট সাইকোমেডিসিন তৈরীর পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন বলে গবেষকরা মনে করেন।এটা মানবজাতির জন্য আশাব্যঞ্জক খবর।তবে হতাশার খবর হলো এর বিপরীত দিকও আছে।নেসিবো ইফেক্ট নামে আরেকটি ব্যবস্থা আছে যা শুধুমাত্র মানসিক বিশ্বাসের ফলে ছোট রোগকে বড় রোগে পরিণত করে বা শুধুমাত্র এই চিন্তার ফলেই রোগ সৃষ্টি হয়।সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন কথা হবে।
লেখাঃ
এস.কে.এম. হেদায়েত উল্লাহ্
শিক্ষার্থী,প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র:অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস,হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট।
মানিকগঞ্জ২৪.কম/এস.কে./২৮মে/২০১৮