মাদক আগ্রাসন ও বর্তমান প্রজন্মের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়

মোঃ আব্দুল মালেকঃ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর কর্তৃক অদ্য ২৭/০৭/২০১৭ সন্ধা ৭.২৫ টায় মোবাইল ম্যাসেজ পেলাম “মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের আহব্বান,““শিশু ও যুবদের আগে শুনুন, নিরাপদ বেড়ে উঠা নিশ্চিত করি।”

অত্যন্ত যুগোপযোগী পদক্ষেপ সম্প্রতি মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। শুধু শহর নয়, গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে গাজা, ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিনসহ নানা নেশাজাতীয় দ্রব্য। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনের কারণে সমাজ ও পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসছে, বেড়েছে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধ। ধনী-দরিদ্র উভয় পরিবারের কিশোর-কিশোরী, বিশেষ করে তরুণসমাজ বিপথগামী হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ পারিবারিক ও সামাজিক উদ্যোগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবাই।

মাদকের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে খোলামেলা মাদকের নামটি আসে তাহল ধূমপান, অর্থাৎ  মাদকের নাটের গুরু হচ্ছে ধূমপান। একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। এর মধ্যে ৪৪ ভাগই বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িত। বর্তমানে তামাকবিরোধী আইন অনেকটাই বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিজ্ঞাপন বন্ধ করছে, জনসম্মুখে ধূমপান করলে জরিমানাও করছে। কিন্তু অন্য মাদকের দিকে তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে। এখন নেশার রাজা হয়েছে ইয়াবা। আমরা এর জন্য সব মহলকে দোষারোপ করছি কিন্তু সমাধান নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কর্তৃক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়,পৃথিবীতে মাদক অপরাধে মোবাইল কোর্ট যদি দুই-একটা দেশে থাকে তাহলে তার অন্যতম বাংলাদেশ। মাদক নিয়ে পৃথিবীতে যত আসামি কারাগারে আছে তার ৩০ ভাগ বাংলাদেশে।ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে  মাদক আমাদের সমাজে যে কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করছে, যা আমাদের দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একার পক্ষে নির্মূল করা সম্ভব নয়। ভৌগোলিকভাবে আমাদের অবস্থান এমন জায়গায় যেখানে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের মাদক চোরাচালানের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার হয়। সঙ্গীদের চাপ, ধর্মীয় অনুভূতির অভাব, সুশিক্ষার অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, মাদকের সহজলভ্যতা ও আকাশ সংস্কৃতি মাদকে আকৃষ্ট করে তুলছে।

আমরা একটি পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তারই ধারাবাহিকতায় মাদক কিংবা ফ্যাশন, বিউটি কনটেস্ট এবং হাল আমলের নারীদের সৌন্দর্যের যে প্রতিযোগিতা সেটিও নিয়ে এসেছে। আমরা নারী অধিকারের কথা বলছি, নারীদের আত্মসম্মানের কথা বলছি বটে কিন্তু এখানে যখন আমরা জিরো ফিগারের কথা শুনছি তখন কিন্তু নানাবিধ প্রশ্ন চলে আসে। জিরো ফিগারের জন্য অনেকেই মাদক বেছে নেন। পারিবারিক বন্ধন একটা বিশাল বিষয়। আমাদের একটি পারিবারিক বন্ধন আছে বা ছিল, ধর্মীয় মূল্যবোধ আছে, কিছু অনুশাসন আছে। এখন আমরা একক পরিবারের দিকে ঝুঁকছি। সেখানে একজন বাবা, একজন মা তার সন্তানকে সময় দিতে পারছেন না।

আমরা অনেক বেশি ক্যারিয়ার সচেতন, অসম প্রতিযোগিতায় ঢুকে যাচ্ছি। শুধু মাদকাসক্ত সন্তানকে দোষারোপ করার আগে বাবা-মাকেও দর্পণে নিজের চেহারা দেখা উচিত। নেশার টাকা যোগানোর জন্য অনেক মহিলা  পতিতাবৃত্তি করছে এক মেয়েকে তার ভাই বিক্রি করে দিয়েছে। নেশাগ্রস্ত ছেলের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক মা বলেন তাকে মেরে ফেলতে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলা যায় মাদকের ব্যাপারটি ভীষণ ভয়াবহ। আমাদের মস্তিষ্কে একটি জায়গা আছে যেখানে ভালো লাগা, খারাপ লাগার তীব্র অনুভূতির সাড়া দেয়। যদি কোনোভাবে এই জায়গাটি উদ্দীপিত করা যায় তাহলে আমরা আনন্দিত হই। মাদকের এই ভয়াবহ ক্ষমতা আছে আমাদেরকে সেইভাবে উদ্দীপিত করার। মাদকের আছে সেই বৈশিষ্ট্য, যা গভীর গহনে উদ্দীপিত করতে পারে। প্রথম দিকে মানুষ শখ করে মাদক নেয়। পরে যখন তারা এর প্রতি আসক্ত হয়ে যায় তখন তাকে অস্থির করে ফেলে। ভীষণ যন্ত্রণায় ফেলে দেয়। সেই যন্ত্রণা থামাতেই মূলত মাদক নিতে হয়। মাদক মেধা, মনন, শারীরিক শক্তি সব উজাড় করে নিচ্ছে।

আপনারা মাদক সংক্রান্ত বিচার প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য করলে দেখবেন, গত বছর ১৭ হাজার মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। এ বছর ৩৬ হাজার মাদকের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এ বিচার ব্যবস্থা অবশ্যই আমাদের মনে আশার সঞ্চার করবে। ২০১৪ সালের মাদক সংশোধিত আইনটি সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল আইন। বিশ্বের মাদক ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইরান। তারপর ফ্রান্স, আমেরিকাসহ আরও অনেক দেশ। তাদের প্রযুক্তির অভাব নেই। সে দেশগুলোতে আইনও মানা হয়, তবুও গত বছরের তুলনায় সে বছর মাদক ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছিল। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে চাহিদা যদি নিয়ন্ত্রণ না হয় তাহলে জোগান পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে ১৪৫টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে বছরে ৯ হাজার ২২০ জন মাদকসেবীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। যেখানে প্রতি বছর নতুন ৫ লাখ মাদকসেবী যুক্ত হচ্ছে। এভাবে প্রতিনিয়তই মাদকসেবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর দেশের মোট মাদকসেবীর মধ্যে ৪১ ভাগই বেকার এবং ১৪ ভাগ শিক্ষার্থী। অর্থাৎ ৫৫ ভাগ লোক মাদকের টাকা জোগাতে কারও না কারও ওপর নির্ভর। মাদকসেবীদের থামিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত তাদের চাহিদা বাড়ছে। শিক্ষক কি জানে তার ছাত্র মাদকাসক্ত, বাবা-মা কি জানে তার সন্তান মাদকাসক্ত? আমাদের বিচার ব্যবস্থায় প্রতি বছর ৫০ হাজার মামলা আসে। কিন্তু সমাধান হয় মাত্র এক হাজার। ফলে অপরাধীরা সুযোগ পাচ্ছে।
কীভাবে মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে? কীভাবে মাদক বাজারজাত হচ্ছে? কী করে আমরা এই আগ্রাসন বন্ধ এবং  নিয়ন্ত্রণ করতে পারি?

আসলে আমাদের নিজেদের দিক থেকে সচেতনতার জায়গাতে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। পুলিশ, বিজিবি, র্যা ব ও গোয়েন্দা সংস্থা। তারা তাদের মতো অপারেশন করে। বর্তমানে আমাদের দেশে এক নম্বর সমস্যা মাদক এবং জঙ্গিবাদ। মাদক একটা ভয়াবহ সিন্ডিকেট। মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। মাদক মামলার বাইরের কেউ যদি মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকে তাদের নামও আসা উচিত। মাদক ব্যবসায় জড়িতদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কার্যক্রম ব্যপক চালু করতে হবে। যদিও একার পক্ষে সম্ভব না তবুও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে যতেষ্ট আন্তরিকভাবে কাজ করছে। আমরা  পাশের বাসার মানুষটি কী করে বলতে পারি না। এ বিষয়গুলোতে যদি আমরা নজর না দিই তাহলে এই ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে পারব না। এ জন্য আমাকে পিতা থেকে জননী-পিতা হয়ে উঠতে হবে। আমি যদি আমার সন্তানের কোনো খোঁজ-খবর না রাখি, পাড়া-প্রতিবেশীর খবর না রাখি তাহলে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সঠিক শিক্ষায় দীক্ষিত হতে হবে।যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি জেলা, প্রতিটি শহর এবং প্রতিটি এলাকার মানুষ মন থেকে মাদককে ‘না’ বলবে, মাদকের বিপক্ষে জনমত তৈরি না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজ থেকে মাদক নির্মূল হবে না।  থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো এক সময় মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসনে বন্দী ছিল। তারা মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি ধার্য করে মাদককে সমাজ থেকে নির্মূল করেছে।

সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নাগরিকদের ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধ শিক্ষায় উজ্জীবিত হতে হবে। আমরা সমাজের দুটি বিষয়ে যুদ্ধ করছি এক. জঙ্গিবাদ ও দুই. মাদক। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে অভিভাবকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের দেশের আরেকটি বড় সমস্যা দুর্নীতি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, মাদক সমস্যার মূলে রয়েছে আইন প্রয়োগকারী, তদন্তকারী কর্মকর্তার ত্রুটিপূর্ণ জব্দতালিকা। যে কারণে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়। পর্যায়ক্রমে সবার অবহেলা এই সমস্যাকে জিইয়ে রাখে। অনেক সময় দেখা যায় মূল ব্যবসায়ী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে কিন্তু বহনকারীরা ধরা পড়ে। গডফাদাররা বেঁচে যায়। এতে ন্যায্য বিচার হয় না। দেখা যায় যারা মাদক ব্যবসায়ী তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছেন।মন্দ লোকের সিন্ডিকেট থাকে, কিন্তু ভালো লোকের তেমন সিন্ডিকেট থাকে না। অথচ আমাদের সবার ভালো থাকার জন্য ভালো মানুষের মধ্যে ঐক্য দরকার। তবেই ভালো উদ্যোগ সফল হবে।আইনকে কাজে লাগিয়ে মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত মাফিয়া চক্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হলেও তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে। এই জায়গাগুলোতে সরকারকে কাজ করতে হবে এবং সরকারকে কাজে সহযোগীতা করতে হবে।

 তাই আ্সুন আমরা মাদককে না বলি মাদকের বিপক্ষে  প্রত্যেক এলাকায়  জনমত তৈরি করি, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে পালনে উজ্জীবিত করি, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় কমিটি গঠর করি। সরকারের পাশাপাশি সকলের সন্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবল পারে মাদকের ভয়াবহতা রুখে, সুন্দর সমাজ ও দেশ গঠন করতে।

লেখক: মোঃ আব্দুল মালেক, সচিব বরাইদ ইউনিয়ন পরিষদ, সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ।

মানিকগঞ্জ২৪.কম/হে.উ./২৭ জুলাই/২০১৭

আরো পড়ুুন