কভিড-১৯ এর চেয়েও ভয়াবহ মহামারীর পথ সৃষ্টি করে যাচ্ছি নিজেরাই

ডেস্ক রিপোর্টঃ
 বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই করোনা (কভিড-১৯) নিয়ে তোলপাড় চলছে। একটা ভাইরাস পুরো পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর মানুষ গৃহে বন্দি হয়ে আছে। কিন্তু আজকে কভিড-১৯ নিয়ে কোন আলোচনা করবো না। আলোচনা করবো আমাদের অসচেতনতার জন্যই যে অদূর ভবিষ্যতে কভিড-১৯ এর চেয়েও ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে সেটি নিয়ে। মানুষের শরীরে দুইভাবে রোগ সৃষ্টি হতে পারে। প্রথমত বাইরে থেকে কোন জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে, দ্বিতীয়ত শরীরে অভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা হলে।
বাইরের থেকে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের দ্বারাই বেশিরভাগ রোগ ছড়ায়। তবে ভাইরাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতি করলেও ব্যাকটেরিয়া ক্ষতি এবং উপকার দুটিই করে থাকে। আর পরিবেশে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ এত বেশি যে মাত্র এক গ্রাম মাটিতে কমবেশি চার কোটি ব্যাকটেরিয়াল কোষ থাকতে পারে। আমরা যে পানি পান করি (ফ্রেশ ওয়াটার) সে পানির এক মিলিগ্রামেও প্রায় দশ লক্ষের মতো ব্যাকটেরিয়া থাকে। এমনকি আমাদের শরীরে যে পরিমাণ কোষ আছে তার কয়েকগুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে থাকে। ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে অনেক কাজ করে। তবে কিছু কিছু রোগও এই ব্যাকটেরিয়ার জন্য সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসেবে প্লেগ, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, কলেরা ইত্যাদি রোগের কথা বলা যায়। একটা সময় এসব রোগের কোন প্রতিকার ছিলো না। এসব রোগ হলে মৃত্যু ছিলো নিশ্চিত। একটা সময় কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যেত। কিন্তু এখন এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগ কোন রোগই না কারণ এর ওষুধ এখন মানুষের হাতে আছে। আর এই ওষুধকেই আমরা অ্যান্টিবায়োটিক বলি। এই অ্যান্টিবায়োটিকের জন্যই ব্যাকটেরিয়াল রোগ গুলিকে এখন আমরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছি। কারণ প্রায় প্রতিটা ব্যাকটেরিয়ার জন্যই কোন না কোন অ্যান্টিবায়োটিক আছে। এখন আমরা যেখানে সেখানে খুব সহজেই অ্যান্টিবায়োটিক পাই। এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না যে জীবনের কোন না কোন সময় অ্যান্টিবায়োটিক নেয়নি। কিছু মানুষ নিজেদের ইচ্ছেমতো, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই দেদারসে অ্যান্টিবায়োটিক নিচ্ছেন। কেউ কেউ ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করছেন না। এই ঘটনাকে আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এই ঘটনাই যে ভয়াবহ মহামারীর সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়েই আজ আলোচনা করবো।

 আমরা যখন অ্যান্টিবায়োটিক নিই তখন ব্যাকটেরিয়া মারা যায় তবে এসময় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। আর ব্যাকটেরিয়ার ক্লাস অনুযায়ী আলাদা আলাদা অ্যান্টিবায়োটিক আছে। আমরা যদি নিজেদের ইচ্ছেমতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি বা অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন না করি তাহলে আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়া নিজেদের এমনভাবে পরিবর্তন করবে যে ঐ ব্যাকটেরিয়ার ওপর কোন অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করবে না, এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে আমরা বলি সুপারবাগ। কেউ যদি এই সুপারবাগ দ্বারা রোগে আক্রান্ত হয় তবে তার মৃত্যু মোটামুটি নিশ্চিত কারণ এইক্ষেত্রে কোন ওষুধই কাজ করবে না। আমরা আমাদের অসচেতনতার জন্য ধীরে ধীরে এই সুপারবাগের সংখ্যা নিজেরাই বাড়িয়ে ফেলছি আর মহামারী সৃষ্টির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। সুপারবাগ নিয়ে আলোচনার আগে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ইতোপূর্বে সৃষ্ট কিছু মহামারী নিয়ে আলোচনা করি। সবগুলো মহামারী নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন তাই শুধু বিউবনিক প্লেগ নিয়েই আলোচনা করি। 
ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এই রোগের সৃষ্টি হয়। বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীতে বছরে প্রায় ৮০০০-১০০০ মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হন। তবে পৃথিবীর জ্ঞাত ইতিহাসে এখন পর্যন্ত বিউবনিক প্লেগ তিনটি মহামারীর সৃষ্টি করেছে। প্রথমবার ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্রাট জাস্টিনিয়ান এর সময়ে এই মহামারী দেখা যায় যাতে প্রায় আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ঐতিহাসিক প্রকোপিয়াস তার “হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার” গ্রন্থে এই মহামারী নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয়বার চতুর্দশ শতাব্দীতে এই মহামারী ইউরোপ হয়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়। সর্বশেষ ১৮৯৪ সালের দিকে মাত্র ২ মাসে চীনের উনান প্রদেশের ৮০০০০ ও হংকং এর ২৪০০ মানুষ মারা যায় এই প্লেগের মহামারীতে। ঠিক একইভাবে কলেরা যে ভয়াবহ মহামারীর সৃষ্টি করেছে তা আমাদের সকলেরই জানা। আর ওষুধ থাকার পরও যক্ষ্মায় এখনো প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায় যার বেশিরভাগই আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলে। 
ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট মহামারী কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি। আমাদের হাতে অ্যান্টিবায়োটিক আসার পর আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলাম কিন্তু সুপারবাগের ঘটনা নজরে আসার পর এখন আর নিশ্চিত থাকার কোন উপায় নেই। এখন, বর্তমান সময়েই এই সুপারবাগ কতটা ভয়াবহ রুপ নিয়েছে তা একটু দেখা যাক। প্রতিবছর ইউরোপে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ সুপারবাগের দ্বারা রোগাক্রান্ত হয় এবং গড়ে প্রায় ৫০০০০ মানুষ মারা যায়।
স্ট্যাস্টিস্টিক্স এর হিসাবমতে ২০১৫ সালে পুরো ইউরোপে সুপারবাগের জন্য ৩৩১১০ জন মানুষ মারা গেছে। শুধুমাত্র আমেরিকায় প্রতিবছর অন্তত ২৩০০০ মানুষ সুপারবাগের দ্বারা সৃষ্ট রোগে মারা যায়। পুরো পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৭ লক্ষ মানুষ মারা যায় এবং বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতিবছর ১ কোটি মানুষ সুপারবাগের জন্য মারা যেতে পারেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আইসিইউ’তে যেসব রোগী মারা যান তার আশি ভাগই সুপারবাগের জন্য। এখন আমাদের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার জন্যই এই ভয়াবহ সুপারবাগের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে আর নিজেরাই হয়তো ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের মহামারী তৈরী করছি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনভাবেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করে ও অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে আমরা অনেকটাই এই ভবিষ্যত বিপর্যয় রোধ করতে পারি। এরকম মহামারী কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে করোনা (কভিড-১৯) আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তাই সচেতন হওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই। নিজে সচেতন হই, অন্যকেও সচেতন করি।

তথ্যসূত্রঃ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ), উইকিপিডিয়া, দ্য স্ট্যাটিস্টিক্স।

লেখকঃ এস.কে.এম. হেদায়েত উল্লাহ্
শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

মানিকগঞ্জ২৪.কম/এস.কে/২৩ এপ্রিল/২০২০  
আরো পড়ুুন