আব্দুর রাজ্জাক: “হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে নইলে/ বাঁধবো না বাঁধবো না চুল”— গাঁদা ফুল নিয়ে প্রেম ও প্রকৃতির কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি শোনেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। চুলের বেণীর সাথে পেঁচিয়ে রাখা গাঁদা ফুল যেনো লাস্যময়ী রমণীর মতোই হেসে ওঠেছে মানিকগঞ্জের আনাচে-কানাচে।
শীতকালীন ফুলের মধ্যে গাঁদা অন্যতম। বিবাহ, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, গৃহসজ্জা, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শহীদ দিবস, পূজাসহ সব বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও গৃহসজ্জায় এর ব্যাপক ব্যবহার ফুলটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে।
প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। কুয়াশাভেজা সকালে প্রকৃতি যখন শীতের চাদর মুড়িয়ে থাকে তখন বাগানে উঁকি দেয় গাঁদা ফুল। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে, এমনকি শহরে বাড়ির ছাদে বা বারান্দার টবে- এমন বাহারি রংয়ের গাঁদা চোখে পড়ে।
এক সময় বাড়ির উঠান বা ছাদের উপরে টবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ফুলের উৎপাদন। কিন্তু বর্তমানে সৌখিন উৎপাদকের গন্ডি পেরিয়ে ফুলের ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। শুধু আবাদই নয় বাংলাদেশের ফুল এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। ১৯৯০ এর দশক থেকে গাঁদা বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়।
মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় অধিক হারে এর চাষাবাদ হয়। গাঁদা ফুলের বিভিন্ন জাতের হয়ে থাকে যেমন- ইনকা, গিনি গোল্ড, ইয়েলা সুপ্রিম, গোল্ডস্মিথ, ম্যান ইন দ্য মুন, মেরিয়েটা, হারমনি, লিজন অব অনার ইত্যাদি। এছাড়া বাংলাদেশে সাদা গাঁদা, জাম্বো গাঁদা, হাইব্রিড ও রক্ত বা চাইনিজ গাঁদার চাষাবাদ হয়ে থাকে।
ফুল বিষয়ক একাধিক তথ্য-উপাত্ত সূত্রে জানাযায়, গাঁদা বা গন্ধা (গেন্ধা) একটি সুগন্ধী ফুল যা সর্বত্র সহজে হয়ে থাকে এবং গৃহসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। গাঁদার ইংরেজি নাম গধৎরবমড়ষফ ঋষড়বিৎ. এটি ঈড়সঢ়ড়ংরঃধব পরিবারের একটি সদস্য। বৈজ্ঞানিক নাম ঞধমবঃবং বৎবপঃধ। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রঙের হয়। এ ফুল সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ ও কমলা হলুদ রঙের হয়ে থাকে। আমাদের দেশে চাইনিজ গাঁদা, রাজ গাঁদা, আফ্রিকান ও ফরাসি জাতের গাঁদা বেশি চাষ হয়। রঙ ভেদে গাঁদার জাত হচ্ছে- হলুদ, লাল, কমলা, গাঢ় খয়েরি, লাল হলুদের মিশ্রণ ইত্যাদি।
আফ্রিকান জাতের গাঁদা গাছ সোজা ও লম্বা এবং ৩৫-১০০ সেন্টিমিটার (সেমি) লম্বা হয়। ফুল কমলা, হলুদ ও গাঢ় খয়েরি রঙের ছিটা দাগযুক্ত হয়। ফরাসি গাঁদা গাছ খাটো ও ঝোপালো। ১৫-৩০ সেমি লম্বা হয়। ফুল আকারে ছোট ও রঙ লাল। কমলা গাঁদার গাছ খুব শক্ত। ফুল গাঢ় কমলা। শাখা-প্রশাখা বেশি হওয়ায় ফুল বেশি ধরে। ফুলের আকার ৪ থেকে ৫ সেমি। অনেক দিন পর্যন্ত ফুল ধরে। প্রতি গাছে শতাধীক ফুল পাওয়া যায়।
ফুল চাষীদের কাছ থেকে জানা যায়, দো-আঁশ মাটি গাঁদা চাষের উপযোগী। ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। টবে বা পাত্রে চাষ করলে তিন ভাগ দো-আঁশ, এঁটেল বা দো-আঁশ মাটির সঙ্গে একভাগ গোবর মিশিয়ে সার মাটির মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এরপর সার মাটি, টবে বা পাত্রে বা পলিব্যাগে ভরতে হবে। মাটিতে সার প্রয়োগ প্রতিশতক জমিতে ৪০ কেজি পঁচাগোবর, ২ কেজি ইউরিয়া, ৩ কেজি টিএসপি ও ২ কেজি এমওপি সার মাটির সঙ্গে মেশাতে হবে।
ঘিওরের বানিয়াজুরী এলাকার সিফাত নার্সারীর মালিক আব্দুর রশিদ জানান, গাঁদা ফুলের চারা রোপন করার সময় হলো ডিসেম্বর মাস। এ মাসে চারা রোপন করলে ফুল চাষে বেশী লাভবান হওয়া যায়। একদিকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান অন্য দিকে বিবাহ সাদির কারণে ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকে গাঁদা ফুলের চাহিদা বেড়ে যায়।
গাঁদা ফুল ও পাতার রস মানবদেহের ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকেই। বিশিষ্ট আয়ুর্ব্বেদিক চিকিৎসক উত্তম পালিত বলেন, গাঁদা ফুলের নির্যাস টিউমারের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। গাঁদা ফুলের নির্যাস ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়াও কান পাকা রোগ ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন কেটে গেলে এর নির্যাস মাখলে উপকার পাওয়া যায়। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের তেল ও সুগন্ধি তৈরিতে গাঁদা ফুল ব্যবহৃত হয়।
ঘিওর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আশরাফ উজ্জামান বলেন, শীতকালীন ফুলের মধ্যে গাঁদা অন্যতম। বাংলাদেশে গাঁদা একটি জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ফুল। সাধারণত এটি শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। গাঁদা ফুল বিভিন্ন জাত ও রঙের হয়। গাঁদা ফুলের আছে নানান রকম ঔষধি গুণ।
মানিকগঞ্জ২৪/ হা.ফ/ আ. রা/ ১২ ডিসেম্বর/ ২০১৭।
আরও পড়ুন: