কাগজী লেবুর হাসি খুঁজি কাঁসার থালায়



পার্শ্ববর্তিনী সহযাত্রী তখন ঘুমিয়ে, আমার কাঁধে প্রায় শুয়ে পরেছিলেন। স্কুল ফেরত কৈশোরিক আবেগ ভাসছিলো পাতাল রেলময়। তাদের চোখের ভাষাঠোঁটের ইশারা বিনিময় হচ্ছিল। এক মিশমিশে তামিল
তরুনী এক দাঁতাল শুয়োরের
কোঠরাবদ্ধ হয়ে ওম নিচ্ছিল আসন্ন
শরীরকর্মের।
 একটা বাংলাদেশী বুড়ো সেই দৃশ্য চেটে যাচ্ছে লোলচর্মে। ক্লান্ত দেহে উজ্জীবিত মন নিয়ে আমি
ছুটছি পাতাল ঘরের দিকে। ডন ভ্যালীসেই
যে শুকনো তরুনী শুয়ে আছে এই নগর জুড়ে,
প্রায় মিশে থাকা তার শরীরে যৌবন আসতে কি শুরু করেছে।
জলের নহরের আবছা ছবি খুঁজতে এদিকে সেদিকে নজর মেলতেই একটা গন্ধ! এমন গন্ধ পাতাল রেলে আসার কথা না। উল্টো দিকে বসা কিশোরের খাবার থেকে আলু ভাজার গন্ধটাই স্বাভাবিক। যে গন্ধটা আসছে
তার উৎস সন্ধানের হাল ছেড়ে দেই। আমি জানি গন্ধ ভূতটা আবার সওয়ার হয়েছে। এখন দুপুরের না খাওয়া পেট
আরো চোঁ চোঁ করবেশুকনো ঠোঁট চাটবে আশাহত জিহ্বা। ভাবি গন্ধের কোন
বর্ণনা কি হতে পারে?
জানি না। আমি ছটফট করে উঠি দৃষ্টিতে আর চনমনে হয়ে
উঠি গন্ধে। মগজের কোষে কোষে সেই গন্ধ আমাকে সতেজ করে তোলে। গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা, বোঁটায় কষ ঝরে পড়তে
থাকা কাগজী লেবুর গন্ধ আমাকে মাতাল করে তোলেঅথচ ততোটা মাতাল আমাকে করে না মদিরা।
আমি
রেলের জানালায় দেখি এক থালা শাদা
জুঁই ফুল ভাত কাঁসার থালায়, কাক চক্ষু পুকুরের জল দিয়ে রান্না
করা পাতলা মসুরের ডাল। লাল শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ আর রসুন কাঠের
চুলের দারুন আগুনে কবিতা লিখেছে সর্ষে তেলের ফোড়ন। সেই সোনালী হলদে ডালের গন্ধ ছাপিয়ে পাতে পড়েছে এক টুকরো সবুজাভ,
সাদা কাগজী লেবুর হাসি।
লেবু
চিপে সেই ভাত চটকে, মুখে তুলে খাইয়ে দিতো মাখালারা। হজমের সমস্যা কিংবা জ্বর থেকে ফিরে এলে এই লেবুডাল
দিয়ে চটকানো ভাত অমৃত মনে হতো। আহা কত দিন জ্বর
হয় নাআহা কতদিন অমৃত খাই না!! কতদিন সেই সব সকরুন হাতে
ওঠে না ভাতের লোকমা।
 কাগজী লেবুর এই যে চনমনে
গন্ধ তার ধারে কাছে নেই সাহেবী লাইম বা লেমন। আমার
শৈশবে দেখেছি সাধারনত গ্রামের গেরস্থ বাড়ীর সামনের উঠোনের শেষ মাথায় একটা কাগজী লেবু গাছ থাকতো। ঝোপের মতো বাড়ন্ত সেই গাছে সাদা ফুল হতো, থরেথরে যেন সাজানো থাকতো চকচকে গাঢ় সবুজ কাগজী লেবু।
 
কখনও
দেখেছি কাগজী লেবুর পাতা চিকন চিকন করে কেটে করমচা মাখা, কাঁঠালের মুচি মাখায়। শৈশবে এমনটা কখনও কখনও জুটেছে মেঝ খালা আর ছোট খালার
ছত্রছায়ায় পটুয়াখালীর হ্যাপীনূকে। সেখানে একদা একটা পুকুর ছিলো, তার পাশেই কি ছিলো এক
কাগজী লেবু গাছ? ছিলো মনে হয়, তবে বমার কৈশোরেই পুকুরের মতো তার মৃত্যু ঘটেছিলো। তখন সাপ্তাহিক হাটের ওপরেই নির্ভর করতো বিদ্যুৎহীন, সড়ক বিহীন দক্ষিণের গ্রামগুলো।
বর্ষায়
এক হাঁটু কাঁদা ভেঙ্গে কামলার মাথায় বাজার দিয়ে হাট থেকে ইলিশ কিনে, হাতে ঝুলিয়ে দাদাকে ফিরতে দেখেছি। আর রাতে সেই
ইলিশ রান্নার গন্ধ আরো মোহময় করে তুলতো সন্ধ্যার আগে গাছ থেকে ছিড়ে আনা তাজা কাগজী লেবুর হাসি।
 সে সময় রাতে
কোন ফলবতী গাছ থেকে ফল ছেঁড়া হতো
না, বলা হতো এমনটা করলে গাছ অভিশাপ দেয়। এখনও জানি না এটা কতটা
মিথ্যাহতেওতো পারে, তারওতো জীবন আছে। কাগজী লেবুর গন্ধটা মাথা থেকে সরছে না। বড় কোন মাছ
কি খেতাম ঝাল, ঝোল লেবু ছাড়া? রোজার মাসে ছোলা ভুনা পেঁয়াজকাঁচামরিচ কুচি আর লেবুর রসে
মাখিয়ে তবে মুখে পড়তো মুড়ির সাথে। আহা স্বাদ বটে!! আর মুড়ি মাখানোতে
কাগজী লেবুর সবুজ ছোলা কুচি কুচি করে কেটে রস দিলে স্বাদের
কি খোলতাই হতো।

নিজেই যখন আয়ে পর্যাপ্ত হয়েছি, কাগজী লেবু কিনতাম হালি ধরে। চৈত্রবৈশাখে কাঠফাটা দুপুরে কাগজী লেবুর সরবতআহা প্রানটা জুড়িয়ে দিতো। মনে হতো মজা দীঘিতে জোঁকের ভয়ে ঝুঁপ করে ডুব দিয়ে পালানোর মতো। প্রিয় বরিশালে কুসুম রাঙ্গা আকাশের রং সাদা আলোতে
ভরলেই বলাকায় উত্তমদার হাতে ভাজা পরোটা, সবজি আর কাগকী লেবুর
কাঁচা গন্ধ মেশানো সকালের মাস্তাআহা সেই সোয়াদ লেগে থাকে বহু ঘন্টা পরও।

জিভটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে, এখন আর জোর করেও
শুকনো, তেতো মুখটা থেকে লালা চাটতে পারছে না। নাকে আু ভাজার গন্ধ
অথচ মগজের কোষে কোষে তাজা কাগজী লেবুর চনমনে গন্ধ। উটকো ব্রেকে পাতাল রেল থেমে যায়, নেমে যায়, মাথা থেকে কাগজী লেবুর গন্ধ নেমে যায় সারা শরীরে। আমি ঘোর লাগা মানুষের মতো এক টুকরো সবুজ
কাগজী লেবুর হাসি খুঁজি, এক টুকরো সবুজ
কাগজী লেবুর হাসিকাঁসার থালায়, ধোয়া ওঠা সবুজ জুঁই ফুল ভাতে।
লেখা ও ছবি
সিনিয়র সাংবাদিক Shawkat Milton এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।
মানিকগঞ্জ২৪/
২৩ ফেব্রুয়ারী/ ২০১৮।
আরও পড়ুন:

নিউজের শিরোনাম দেখে আঁতকে উঠবেন

আরো পড়ুুন