মা বেড়াতে গেছেন একা একা।

আমাদের ১২ ভাইবোনকে এতিম
করে আমার পিতা হটাৎ
ইন্তেকাল করলেন ১৯৭৬ সনে।
বরিশালের মহিপুর ফরেস্ট অফিস
তার কর্মস্থল থেকে তিনি লাশ
হয়ে ফিরে এসেছিলেন তার
বাসায়। সংসারের বড় ছেলে আমি
তখনো ছাত্র। সবচেয়ে ছোট
বোন আর ভাই মৃত
আব্বাকে দেখে খেলতে খেলতে
হাসছিল, ওরা বুঝতে পারেনি
কি হারিয়ে গেছে ওদের।
মা ওপর কি
বিশাল বোঝা। বারোটি সন্তান
হয় লেখাপড়া শেষ করবে না
হয় হারিয়ে যাবে কোন
অজানায়

মা দুরাবস্থা দেখে
কেউ যখন বলতো, চিন্তা
করবেন না। মা বলতেন,
আমি চিন্তা করিনা। চিন্তাতো
করবে আল্লায়, যিনি ওদের বাবাকে
নিয়েছেন, চিন্তা তার। আমি
চিন্তা করলে আল্লাহ করবেটা
কি ? মা ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখাতেন,
ঝগড়া, সংঘাত, খামাখা বিষয়
নিয়ে তর্ক বিতর্ক হলে
ঠকে আসবি। যে ব্যাপারে
জিতলে মানুষ অসন্তুষ্ট হয়,
ঝামেলা হয় সেখানে ইচ্ছে
করে ঠকে যাবি, মানুষ
তখন তোকে ভালোবাসবে। বলতেন,
দ্যাখ পৃথিবীর সবাই যদি ঠকতে
ভালোবাসতো তাহলে কি সুখের
পৃথিবী হত

মা ঠকেননি। বাবা চলে যাবার
পরে যে পরিবারের সন্তানদের
স্কুলের গন্ডি পেরুবার অর্থনৈতিক
সঙ্গতি ছিলোনা তার পরিবারে
নয় জন ডাক্তার হয়েছে,
দুজন ডক্টরেট।
 
মা বলতেন, লেখাপড়ার ইচ্ছে
থাকলে যেকোন অবস্থান থেকে
মানুষ শিখতে পারে। হাসতে
হাসতে বলতেন, আমি সিক্স
পর্যন্ত পড়েছি, সুযোগ পেলে
আমি দুটো ডক্টরেট নিতাম।
তোদেরকে পুষতে যেয়ে সেটি
আর হলোনা
মাকে বলেছিলাম, তুমি কি জানো
ডক্টরেট কি ?

বরিশালী ভাষায় জবাব দিয়েছিলেন,
জানমুনা ক্যা ? লেখাপড়া করে
যেটা পাওয়া যায় সেটা
হইলো আসল ডক্টরেট, আর
লেখাপড়া না করে যেটা
পাওয়া যায় সেটা হইলো
বানাইন্যা ডক্টরেট। বানাইন্যা জিনিষ দিয়া গর্ব
করার, খুশি হবার কিছু
নাই, মানুষে সামনে কিছু
কইবেনা, কিন্তু পিছনে হাসবে

একবার মাকে বললাম,
মা রাজনীতি করতে চাই, তুমি
অনুমতি দাও। মা
জবাব ছিল, এই কাম
কোনোদিন করবিনা। আমার কবরের পাশ
দিয়ে যাবার সময় মানুষে
গালি দিবে, —এইটা হইলো ওই
শয়তানটার মায়ের কবর। রাজনীতি
করে মানুষকে খুশি করা যায়না

ডাক্তারী টেক্সট বুকে আছে
পাকস্থলীর ক্যানসার হলে মানুষ চিকিৎসার
পরেও পাঁচ বছরের বেশি
বাঁচেনা। মা অপারেশনের পরে
১৪ বছর বেঁচে ছিলেন।
গ্রামের মানুষজন আত্মীয় স্বজন সবার
সাথে যোগাযোগ রেখেছেন সারা জীবন, সাহায্য
সহায়তা করেছেন তাঁর সাধ্যের
বাইরেও। তার সব ছেলেমেয়ের
অনেক বন্ধু বান্ধবীরা তাদের
মনঃকষ্ট হলে মায়ের কাছে
আসতো, তার পরামর্শ নাকি
তাদের কাজে লাগতো।
 
মা এতিমখানা গুলি ঘুরে বেড়াতেন,
আলেমদের সহায়তা করতেন। অনেক
বছর ধরে নিজ গ্রামে
ক্লিনিক চালান ডাক্তার দিয়ে,
গ্রামের প্যারালাইজড রোগীদের ফিজিওথেরাপি দেয়ার কাজ শুরু
করেছিলেন। আমরা ডাক্তার হয়ে
যা ভাবিনি তা নিয়ে
তিনি কাজে নেমেছিলেন অর্থ
সংগ্রহের। সমাজ কল্যাণের কাজের
জন্য মা চাঁদাবাজি
অবিশ্যি তার ছেলেমেয়েদের মধ্যেই
সীমাবদ্ধ ছিল। মা
নামে ছোট একটি রাস্তা
হয়েছে আমাদের ডহরপাড়া গ্রামে।
রত্নগর্ভা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি

মা অসিয়ত ছিল
মৃত্যুকালে আমাকে পাইপ, সুই,
মেশিনের মধ্যে রাখবিনা, সব
ছেলেমেয়েরা শুধু কলেমা লা
ইলাহা ইল্লাআল্লাহ পড়বি আমাকে ঘিরে।
 

হাসপাতালে থাকলেও আমাদের ডাক্তার
বন্ধুরা মাকে আই সি
ইউতে লাইফ সাপোর্টে নেয়নি,
আমরাও চাইনি। ভাইবোনরা ছয়
ঘন্টা ধরে কলেমা পড়েছি
জোরে জোরে। মা মুখ
দিয়ে বড় বড় শ্বাস
নিচ্ছিলেন। আমরা তার মুখে
ড্রপারে ফোটা পানি দিচ্ছিলাম
জমজমের। একসময় আমাদের লা
ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাথে তার শ্বাস
নেয়া ফেলা মিলে গিয়েছিল,
একবারইল্লাল্লাহউচ্চারণের সাথে সাথে তিনি
তার মুখে জমে থাকা
আবে জমজমের পানিটুকু গিলে
ফেললেন আর চলে গেলেন
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে। ইন্না লিল্লাহে
ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
শুকনো আটা থেকে একটি
চুল টেনে বের করা
যেমন সহজ তেমনি সহজ
ভাবে তিনি চলে গেলেন।
তখন রাত সাড়ে এগারোটা
চব্বিশে জানুয়ারি, ২০১৮

মা কথা বলা
বন্ধ হয়েছিল মৃত্যুর একদিন
আগে। পরের দিন জ্ঞান
হারানোর আগে চোখ মেলেছিলেন
মাত্র একবার। সে মুহূর্তে
বহু কষ্টে তার দু
বাহুকে প্রসারিত করেছিলেন, আমরা অবাক হয়ে
দেখছিলাম। তিনি তার দুহাতের
আঙুলগুলো একটির ভিতরে অপরটি
ঢুকিয়ে যুক্ত করে ইশারা
করলেন, তোরা সবাই মিলেমিশে
থাকবি, বিচ্ছিন্ন হবিনা, তার সর্বশেষ
শক্তি দিয়ে শক্ত মুঠি
বানিয়ে বুঝিয়ে গেলেন তোদের
ঐক্যই হবে শক্তি। মুখের
ভাষা দিয়ে না বললেও
তার কথা আমরা সবাই
বুঝেছি। এটিই ছিল তার
শেষ অসিয়ত

পঁচিশ তারিখ মাগরিব আজানের
আগে মাকে আমরা
চার ভাই কবরে শুইয়ে
দিয়েছি। আমার কোলে মায়ের
মাথা। কবরে নামানোর পর
কফিনের ভেতর থেকে মায়ের
মুখমন্ডল অনুভূত হচ্ছিল তখনো
আমার হাতে। মায়ের মুখমন্ডল
মাটিতে শুইয়ে দিলাম, কেবলার
দিকে মুখ। কবরের গর্তে
বসে আল্লাহর কাছে হাত উঠলাম,
আল্লাহ মাফ করে দিও
আমার মাকে আর
সব মৃত মাকে।

হটাৎ মনে হল, কবরের
ভেতর কে যেন আমার
কানে কানে বলছে, দূর
বোকা কারো মা কখনো
মরেনা, তারা বেঁচেই থাকে
সন্তানদের কাছে। সবার মায়েরা
শুধু বেড়াতে যায় আল্লাহর
কাছে, আল্লাহর আদরের আহবানে
আমার মা এখন পৃথিবীতে
নেই, আমার চোখে খামাখা
পানি আসলেও আমি আসলে
কাদঁছিনা। কারো মা কখনো
মরেনা। দোয়া চাই সবার কাছে।
  
লেখা
আরিফুর রহমান এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।

মানিকগঞ্জ২৪/হা.ফ/
১ ফেব্রুয়ারী/ ২০১৮।
আরও
পড়ুন:

শিক্ষামন্ত্রী কেটে পড়লে সবার জন্যে ভালো হয়

আরো পড়ুুন