নিজস্ব প্রতিনিধি, ৩ জুলাই:
ল্যাংড়া, ফজলি, কাঁচামিঠা, আশ্বিনা, বাদশা ভোগ বা রাণীভোগ, সূর্যপুরী, মালদাজর্দা আম,শাহ পছন্দ, বেল আম,সফেদা আম,সিন্দুরে আম,আড়া জংলা বা আড়া জন্মানী,কাল্যা আম, তুরতুরি আম, ক্ষীরসা পাতি,গোপাল ভোগ আরও কতকি নাম। আবার এখন হাড়িভাঙ্গা আমের নাম বেশ শুনা যাচ্ছে।
ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর সুখ। আসলে যারা পায়নি, তাদেরকে বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভবও নয় সেই সুখ। ঝড় শুরু হলে আম গাছের নিচে আম পড়ে থাকত। পাড়ার বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই বেড়িয়ে পড়ত আম নিয়ে ঘরে ফিরত। মায়েরা সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আচার বানাতেন। মাঝে মাঝে গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে অনেকে আহত হতো। তবে আম কুড়ানোর সেই আনন্দ ও উন্মাদনা রুখতে পারত না কোনো কিছুই। সে সব কিছুই আজ স্মৃতি।
গ্রীষ্মকালে হরেক পদের ফলের সমাহার থাকে। এজন্য মধুমাস বলা হয় এই মাসকেই। ফলের রাজা আম বারোমাস পাওয়া গেলেও গাছপাকা আম খাওয়ার সময় মুক্ষম সময় যাচ্ছে এখন। আম খান না বা পছন্দ করেন না এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন।
বিভিন্ন ধরনের আম পাওয়া যায় বাজারে। একেক জাতের আমের রয়েছে আকার এবং স্বাদের ভিন্নতা। তবে আম কত প্রকার জানেন কি? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেন তেন কর্ম নয়। খোদ চাঁপানবাবগঞ্জ বা ভারতের মালদার কেউই সঠিকভাবে এর সংখ্যা বলতে পারে না।
ইউরোপ আমেরিকার আপেলের নাকি কমপক্ষে ৩০০ ধরণ রয়েছে। সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আমের ধরণ এর থেকে কম নয়। বেশি হবে বৈকি! আপেল শীতপ্রধান দেশে জন্মালেও আম পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই জন্মে। এশিয়ার প্রায় সব দেশে তো বটেই, সুদুর পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনেও রয়েছে অঢেল আমের ফলন। লন্ডনে কয়েক রকমের দারুন স্বাদের পাকিস্তানি আম পাওয়া যায়। কম্বোডিয়া, অস্ট্রেলিয়াতেও প্রচুর ভালো মানের আমের চাষ হয়। সেখানে প্রায় মাইল খানিক আমের বাগান রয়েছে।
আমের কথা শুনলেই প্রথমেই মনে আসে রাজশাহী বা চাঁপানবাবগঞ্জের নাম। তবে এই দুটি জেলা ছাড়াও রাজশাহী বিভাগের বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও প্রচুর আমের ফলন হয়। যা বেশ ভালো মানের এবং স্বাদের। ইদানিং খাগড়াছড়ির মতো পাহাড়ি এলাকাতেও বিস্তর আমের ফলন হচ্ছে। বগুড়ায় হরেক রকমের আমের ফলন হয় প্রায় শতাব্দীকাল আগে থেকেই। সেটা পঞ্চাশের শেষ ও ষাটের দশকের কথা।
এসব এলাকায় বেশিরভাগ আমের গাছ বা বাগান ছিল মানুষের নিজস্ব সম্পত্তি। এখনকার মতো জমি ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ কমই হত। নিজেদের চাহিদা মেটাতে বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো হতো আমের গাছ। অন্যান্য ফলের পাশাপাশি ১০ থেকে ২০টি গাছ অনেকেরই থাকত। অনেকেই নিশ্চয় ছেলেবেলায় ফিরে গেছেন?
পুটলিতে লবণ মরিচের মিশ্রণ নিয়ে দল বেঁধে ঘুরে বেরাতেন আম বাগানে। গাছের উপর বসেই খাওয়া হত কাঁচা পাকা আম। যাদের অনেক গাছ ছিল আম একটু গুটি বাঁধতেই ব্যবসায়ীরা বাগানগুলো নিলামে আগাম কিনে নিয়ে যেত। তারাই সারা মৌসুম ধরে পরিচর্যা করত। মাচা বেঁধে সারারাত পাহারা দিত।
দেশীয় জাতের আমগুলো পাকত সবার আগে। গরমের শুরুতেই এই আম পেকে যেত। সেই আমের পেছন দিকে ফুটো করে মুখে লাগিয়ে টিপে টিপে ফিডারের মতো রস খেয়েছেন নিশ্চয়। পাইকারিভাবে আম কেনাবেচা হতো শতক হিসেবে। দুইভাবে সেই শতক হিসাব হতো। কাঁচির শ আর পাকির শ।
অর্থাৎ ২৫ হালির অতিরিক্ত আরো এক হালি ফাও বা উপরি মোট ১০৪ টা আমের নাম কাঁচির শ। তেমনি ৫০ হালির সঙ্গে আরো দুই হালি যোগ করে ২০৮ টা আম মানে পাকির শ। তার উপরেও দু চারটা আম এমনিতেই বেশি দিত বিক্রেতারা। আগের এই হিসাব অবশ্য এখন আর চলেনা। এখন বিক্রি হয় কেজি হিসাবে।
বগুরা, দিনাজপুর এলাকাগুলো সমতল না। এখানে মাঝে মাঝেই উঁচু ভিটা। তার বেশির ভাগ যেহেতু ধানচাষের উপযোগী ছিলনা। তাই সেখানে মানুষ বিভিন্ন রকমের গাছ লাগাত। যার মধ্যে আমই বেশি। এসব এলাকার কয়েক জাতের আমের ধরণ জেনে নিন-
জর্দা আম: এই আম সাইজে বেশ ছোট। তিন ইঞ্চির মতো লম্বা। ওজন ৫০ থেকে ১৫০ গ্রামের মধ্যে। কাঁচা অবস্থায় খুব টক। তবে পাকলে অপূর্ব মিষ্টি স্বাদ। এর বিশেষত্ব হচ্ছে এর কোনো আঁশ হয়না এবং বেশ রসালো। পাকা আমের খোসা ছাড়ানো বেশ সহজ। মুঠোয় নিয়ে একটু চাপ দিলে আঁটি পিছলে বের হয়ে যায়। তবে এই জাতের আম এখন তেমন চোখে পড়ে না।
শাহ পছন্দ : স্থানীয় ভাষায় মাঝারি সাইজের এই জাতের আমকে বলা হয় শাপচন। পাকলে টকটকে হলুদ হয়। সুগন্ধযুক্ত রসালো মিষ্টি আম। রাণী পছন্দ আমের চেয়ে একটু বড় হয়। এখন এই আম পাওয়া যায় না।
বেল আম: মেটে সবুজ রঙের আম। পাকলেও তেমনি থাকে। প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের। তবে এই আমের আঠা একটু বেশি ছিল। পাকলে খেতে অনেকটা বেলের স্বাদ পাওয়া যেত বলে একে বেল আম বলে অনেকে।
সফেদা আম: ফজলী আমের মতো লম্বাটে গৌর বর্ণের আম। কাঁচাতেও টক কম, পাকলে সফেদা ফলের মতো মিষ্টি। কোনো আঁশ নেই।
সিন্দুরে আম: গোলাকার ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম সাইজের মেটে সবুজ আম। পোক্ত হলে বা পাকার আগে উপরের অংশে সিন্দুরের গুঁড়ার মত দাগ ফুটে উঠত। দারুণ সুস্বাদু আঁশহীন আম।
আড়া জংলা বা আড়া জন্মানী: মাঝারী ১০০ থেকে ১২৫ গ্রাম সাইজ। কাঁচা রং সবুজ, পাকলে রাঙা হলুদ। পাকলে অপূর্ব সুগন্ধ ও হালকা আঁশযুক্ত রসালো মিষ্টি।
কাল্যা আম: মাঝারি সাইজের কালো রঙের আম। কাঁচায় মহা টক। পাকলে দারুণ স্বাদের মিষ্টি। একটু আঁশযুক্ত। এখন খুব একটা দেখা যায়না।
তুরতুরি আম: বিশাল গাছে লিচুর মত ফলন হয়। পাকার সময় হলে মিনিটে মিনিটে আম পড়ত বলে নাম ছিল তুরতুরি আম। এটা দেশি বা বুনো জাতের আম। চমৎকার রসালো মিষ্টি।
ক্ষীরসা পাতি: ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম সাইজের উন্নত আম। দারুণ স্বাদের মিষ্টি আঁশহীন আম। এই আম ব্যাপকভাবে রাজশাহী এলাকায় হয়। এরই কাছাকাছি জাতটি এখন হিমসাগর বলে পরিচিত।
এছাড়াও রয়েছে ল্যাংড়া, ফজলি, কাঁচামিঠা, আশ্বিনা, বাদশা ভোগ বা রাণীভোগ, সূর্যপুরী, মালদা এবং বারোমাসি আমের গাছ। শত শত দেশি এবং বুনো জাতের নাম না জানা আম রয়েছে। এইসব বিভিন্ন জাতের আম প্রায় বিলুপ্ত। দুই একটা বাড়িতে পুরনো কিছু গাছ রয়েছে। তবে বয়সের ভারে তেমন ফল দেয় না আর। বাণিজ্যিকভাবে সফল আমগুলোই এখন বেশি চাষ করা হয়।
বিভিন্ন গবেষণা করে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। যেমন, ১৯৯৫ সালে সাতক্ষীরা থেকে ভারতে উদ্ভাবিত আম্রপালী ও নীলাম্বরী। রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আমের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। শত শত আমের মধ্যে হয়ত মাত্র কয়েকটির নাম আমরা জানি। সে যাই হোক, বাঙালিয়ানার সঙ্গে আমের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
মানিকগঞ্জ২৪/ ৩ জুলাই ২০২০।