![]() |
রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক দ্বীন ইসলামের মা ছেলে ছবি নিয়ে কাদছেন। |
হাসান ফয়জী: সাভারের রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক কবিতা বেগম। মা রাজেদা বেগমের নিজ বাড়ীতে গেলে কবিতার কথা বলতেই কেদে ফেলেন। বিলাপ করে বলতে থাকেন, কবিতা হেসকার কালে বাড়ী আইছিল পহলো বৈশাখ, মনয় ১৪ ই এপ্রিল। মাইয়াডা বাজার তন তরমুজ কিনা আইছিল। নিজের আতে কাইটা বাড়ীর হগলরে খাইয়াল। যাইবার সময় বলছিল মা আবার বাড়ী আহনের সময় তোমাগ লিগা গরুর মাংস আনুম। হেই যে গেল কবিতা গরুর মাংস আনব কইয়া, কবিতা বাড়ী আইল ঠিকই লাস হইয়া। এ কথা বলতেই আর কথা বলতে পারছিল না রাজেদা বেগম।
২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজায় ধসে পড়ে শত শত গার্মেন্টস কর্মী নিহত হয়, আহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে মানিকগঞ্জে ৬০ জন শ্রমিক নিহত হয়। এদের মধ্যে কবিতা বেগম। তার বাবার বাড়ী সাটুরিয়া উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নের গ্রামে। সোমবার (২৩) এপ্রিল সকালে কবিতা বেগমের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায় তার মা রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন। রাজেদা বেগম বলেন, কবিতারে বিয়া দিছিলাম, কিন্ত স্বামীর ভাত খাইলনা। পরে নিজের পায়ে দারনের লিগা কাম নেয় রানা প্লাজায়। কিন্তু নিজের পায়ে দারনের আগেই মাইয়াডা মারা গেলে।
একই গ্রামের সোহেল, বড় ভাইয়ের সাথে কাজ করতেন রানা প্লাজায়। সোহেল বলেন প্রতিদিনের মত ২৪ এপ্রিল কাজ করতে রানা প্লাজায় যান। তিনি ৮ তালায় কাজ করছিলনে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করে বিকট শব্দ হয়। এর পর জ্ঞান ফেরার পর দেখেন ধুলা ও অন্ধকার কিছুই দেখছি না। শুধু মনে হল আমার মাথার উপর আধা হাত জায়গা আছে। হামাগুরি দিয়ে একটু আলো দেখতে পাই। আলো ধরে এগুতে থাকি পরে উপর থেকে লাফ দেই। পরে দেখি ৮ তলা থেকে লাফ দিয়েছি। সামান্য ব্যাথা পেলেও আমার বড় ভাই জাহাঙ্গীর কে আর খুজে পাই না।
রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীর বাবা আরান সিকদার বলেন, আমার ২ ছেলে রানা প্লাজায় আক্রান্ত হয়। ছোট ছেলে সোহেল কে পেলেও বড় ছেলে জাহাঙ্গীর কে এখনও খোজে পাই নি। সবার লাশ পেলেও বড় ছেলে জাহাঙ্গীর কে আর খোজে পাই নি। পরে মরদেহের সাথে আমাদের ডিএনএ টেষ্ট করার পর নিশ্চিত হই আমার বড় ছেলে মারা গেছে। আমার বাবার কবর টা বাড়ীতে থাকলে তাও নয়নটা জুড়াইতে পারতাম।
আরান সিকদার আরো বলেন, আমাদের ৩ বার নোটিশ দিল সেখা লেখা ১৫ লক্ষ ৬১ হাজার ২ শত ৩৭ টাকা সাহায্য পাব। কিন্তু কয়েক দাপে টাকা পেলাম সব মিলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা । আর টাকা গেল কোথায়। নোটিশ মুতাবেক টাকা দিলে কিছুটা ভাল করে চলতে পারব।
বরাইদ গ্রামের আরেক নিহত শ্রমিক শিপরা রাজবংশী শীলা (২০), শশুর কালাচান রাজবংশী বলেন, আমার ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র রাজবংশীর সাথে বিয়ের ৩ মাসের মাথায় সংসারের স্বচ্ছলতা আনার জন্য সাভারে চলে যায়। শিপরা রানা প্লাজায় কাজ করত আর ছেলে মাছ বিক্রি করত। কিন্ত কয়েক মাসের মাথায় শিপরা মারা যায় রানা প্লাজা ধসে।
সাটুরিয়া উপজেলা পরিষদ ঘেষে বালিয়াটী গ্রাম। এ গ্রামের খুব জনপ্রিয় ও টগবগে তরুণ দ্বীন ইসলাম। এইস, এস,সি পাশ করে পড়া শুনার পাশা- পাশি কাজ নিয়েছেলেন রানা প্লাজায়। ২ সন্তানের জনক দ্বীন ইসলাম রানা প্লাজার ধসের ১২ দিন পর তার মরদেহ খুজে পান স্বজনরা।
রবিবার সকালে তাদের বাড়ীতে গেলে দেখা যায়, তার মা মনরা বেগম দ্বীন ইসলামের ছবি হাতে নিয়ে কাদছেন। ওরে আমি আদর করতাম বলে অন্য পোলাপানরা বলত আমি শুধু ওরে আদর করি। পোলাডা বাইছা থাকলে ওর ছেলে ও মেয়ে আমারে বুঝি বুঝি বইলা ডাকত। দ্বীন ইসলামও নাই বুঝি বুঝি কইরা আমারে কেউ ডাকেও না।
নিহত শ্রমিক দ্বীন ইসলামের ভাই মনির হোসেন বলেন, আমি সামান্য ইলেকট্রনিকের কাজ করি। আমার মৃত ভাইয়ের ২ সন্তান। আমার সামর্থ নাই তাদের সহযোগীতা করব। সরকার আমার ভাইয়ের এতিম সন্তাননের মত অন্যন্য সন্তানদের পড়াশুনা খরচ বহন করত তাহলে ওরা মানুষ হতে পারত।
দ্বীন ইসলামের বোন রুমা বেগম বলেন, রানা প্লাজায় যারা নিহত শ্রমিকদের স্ত্রী ও স্বামীরা অন্যত্র বিয়ে করে তাদের স্বামী এবং স্ত্রী পেয়েছে। আমার ভাবীও অন্যত্র বিয়ে করে নতুন সন্তান জন্ম দিয়েছে। আমরা ত আর ভাই পাই নি। প্রতিবছর এই দিনটা আসলে ভয়ে আৎকে উঠি। আমার ভাই কত কষ্ট করে মারা গেছে।
সাভারের রানা প্লাজায় ধসে নিহত প্রায় ১০-১৫ জন শ্রমিকের বাড়ীতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সাহায্য পেলেও তারা এখনও স্বচ্ছল হয়ে উঠতে পারেনি। সংসারের আলো জ্বালানোর জন্য এসব হতভাগা গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাড়ী ছেড়েছিল। অথচ আলো জ্বালানোর আগেই তাদের জীবনের প্রদিপ বন্ধ হয়ে লাশ হয়ে ফিরেছেন। তাদের রেখে যাওয়া সংসারের বাতি এখনও টিপ টিপ করে জ¦লছে।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ত্রাণ শাখার অফিস সহকারী মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, মানিকগঞ্জের ৬০ জন শ্রমিক নিহত হয়। এর মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছে ৩৮ এবং পুরুষ শ্রমিক ২২ জন। জেলায় নিহত ৬০ জন শ্রমিকের মধ্যে সাটুরিয়ায় নিহত শ্রমিক ৪, শিবালয় ৭, ঘিওর ৬, দৌলতপুর ১৮, সিংগাইর ৮, মানিকগঞ্জ সদরে ৭ এবং হরিরামপুর উপজেলায় ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে।
তবে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকের কোন সংখ্যা মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কোন অধিদপ্তর জানাতে পারে নি।
এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. নাজমুছ সাদাত সেলিম বলেন, মানিকগঞ্জে ৩ ধাপে রানা প্লাজায় ধসের নিহতের তালিকা তৈরি হয়েছিল। প্রথম ধাপে ২৭জন, ২য় ধাপের ২৩ জন এবং সর্বশেষ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ১০ জন সহ মোট ৬০ জন নিহত শ্রমিক রয়েছে। নিহত শ্রমিকদের সন্তানদের পড়াশুনা অর্থের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে বিষয়টি আমার জানা ছিল না। কোন পরিবার যদি আমার নিকট এ ব্যাপারে আসে তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা প্রধান করব। আর ১৫ লক্ষ টাকার বিপরীতে ৪ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে আমার কোন তথ্য জানা নেই।
মানিকগঞ্জ২৪/ হা.ফ/ ২৪ এপ্রিল ২০১৮।
আরও পড়ুন: বিএনপির প্রয়াত মহাসচিবের বড় ছেলে কে মানিকগঞ্জ ছাড়তে বাধ্য করল পুলিশ