ঝি-র কাজ করে সংসার চালাই ঘর দিমু কেমনে

নবীরন বেওয়া তার আগের পাখির বাসা সাদৃশ্য কুড়ে ঘরের সামনে

মোহাম্মদ হাসান ফয়জী: হাসেনা বেগম  অন্যের বাড়ীতে ঝি-র করে সংসার চালান। যে দিন কাজ করতে যেতে পারেন না সে দিন তার সংসারে চুলায় আগুন জ্বলে না। তারও সুখের সংসার ছিল নিয়মিত বাজারের ব্যাগ ভরে বাজারও আসত। কিন্তু তার স্বামী মইন উদ্দিন  প্যারালাইসড হয়ে ঘরে পরে আছে। তার  স্কুল পড়ুয়া ছেলে আর অসুস্থ স্বামীর ভার এখন  হাসেনা বেগমের হাতে।

অন্যের বাড়ির বাঁশঝাড়ের নিচে একটি ঘর তুলে কোন রকম আবাস গেড়ে ছিলেন। নুন আনতে পানতা ফূরায় যে সংসারে তার আবার ঘর। বৃষ্টি আসলেই ঘুম থেকে উঠে বসে থাকতে হত। ঘরটি সম্পূর্ণ থাকার অযোগ্য হয়ে পড়ে।

স্টাুরিয়া উপজেলার ফুকুরহাটি ইউনিয়নের কৃষ্টপুর গ্রামের নবিরন বেওয়া। স্বামী ৪০ বছর আগে চলে গেছে, সেই থেকে একলা চলার যুদ্ধ। এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে একাই চলছে তার জীবন। বয়স তার এখন ৯০ ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে শরীর তার চলে না। তাই তার শোয়ার ঘর এখন পাখির বাসা হয়েছে। তার থাকার ঘরটি এখন লতা পাতা ও গাছের মরা ডাল দিয়ে সাজিয়ে রাত্রিযাপন করেন।

নবীরন বেওয়ার নতুন স্বপ্নের ঘরে সামনে “সাটুরিয়া ফার্স্ট” গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ডা: রফিকুল ইসলাম খানের সাথে

এমন অসহায় মানুষ খুঁজে বেড়ান মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া ফার্স্ট গ্রুপ নামে একটি সামজিক সংগঠন। তাদের গ্রুপে এমন অসহায় ঘরহীন মানুষের ছবি পোষ্ট দিলেই ছুটে বেড়ান এই গ্রুপের সদস্যরা। যখন দেখবে সত্যিই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে থাকার ঘরটি। যেমন কথা তেমনি কাজ। তারা স্পটেই থাকতেই দুচালা ঘরের জন্য সিমেন্টের খুঁটি, নতুন টিন, দরজা, জানালাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র চলে আসে। পরের দিন বেলা উঠার সংগে সংগে নতুন ঘরের কাজ শুরু হয়ে যায়। ২- ৩ দিনের মধ্যেই উঠে যায় ঘরহীন মানুষের স্বপ্নের ঘরটি।

ফুকুরহাটির শাইপড়া গ্রামের আবুল হোসেন তার নতুন ঘরের সামনে

এমন খবর পেয়ে শুক্রবার বিকালে সাটুরিয়া ফার্স্ট গ্রুপের পক্ষ থেকে ঘরহীন মানুষদের ঘরে ফেরা দেখতে যাওয়া হয়। প্রথমে গিয়ে দেখা যায়, হাসেনা বেগমের বাড়ী। তার অসুস্থ স্বামী মইন উদ্দিন শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসেন হাসেনা বেগম। তিনি জানান, “আমার স্বামী প্যারালাইসড হয়ে অক্ষম হয়ে গেছেন। এখন আমাকেই ছাগল পালন করে ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে পুত্র সন্তান নিয়ে ৩ জনের সংসার আমাকেই টানতে হচ্ছে।” হাসেনা বেগম আরো জানান, “আমার থাকার ঘরটি সম্পুর্ণ অচল হয়ে পড়ে ছিল। এমন খবর পেয়ে রফিক ( ড. রফিকুল ইসলাম খান, “সাটুরিয়া ফার্স্ট” গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা) নামে একলোক আমাকে একটি ঘর তুলে দেন।”

বৈলতলা গ্রামের ফারুক হোসেন তার পরিবার নিয়ে তার নতুন ঘরে সামনে

“সাটুরিয়া ফার্স্ট” ফেসবুক গ্রুপ এর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন ডা. রফিকুল ইসলাম খান। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অবিরাম ছুটে চলেছেন উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তরে। তার অন্যতম প্রকল্প হচ্ছে ঘরহীন মানুষকে ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা।

সাটুরিয়ার পাড়াগ্রামের হাসিনা বেগমের সাটুরিয়া ফ্রাষ্ট গ্রুপের দেওয়া  নতুন ঘরে উঠছেন অসুস্থ্য স্বামী কে নিয়ে

ফুকুরহাটির কৃষ্টপুর গ্রামের নবীরন বেওয়ার বাড়ী গিয়ে দেখা যায়, তার খুশির শেষ নেই। তার ঘরের কাজ কাঠ মিস্ত্রিরা বুঝিয়ে দিলেও অনেক কাজ বাকি। নবীরন বেওয়া নতুন ঘর পেয়ে গীত গাচ্ছেন আর ঘরের ভিটে বাঁধছেন। আনন্দের সাথে তিনি জানান, আগে থাকতাম পাখির বাসায় এখন রফিক ভাই ঘর দিছে, আল্লাহ যেন আমাকে এই ঘরেই মরতে দেন।

একই উপজেলার সাটুরিয়া ইউনিয়নের বৈলতলা গ্রামের মৃত: মান্নানের পুত্র ফারুক হোসেনকে ৪ সন্তান সহ ৬ সদস্যের সংসার চালাতে হয়। ভ্যান চালিয়ে কোন রকম এক বেলা ভাত জুটিয়ে আর এক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। ফুকুরহাটি ইউনিয়নের শাইপাড়া গ্রামের মৃত জমির আলীর পুত্র আবুল হোসেন পেশায় একজন শ্রমিক। সারা দিন কাজ করে যা পান, তা দিয়ে কোনরকমে চলে সংসার। তারও ভাঙ্গা ঘরে থাকতে হয়। তার বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায় তিনি ঘরে উঠেছেন। 

এ ব্যাপারে  সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুক এর “সাটুরিয়া ফার্স্ট” গ্রুপের এর প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ রফিকুল ইসলাম খান জানান, “আমি সারা জীবন যা আয় করেছি তা অসহায় মানুষদের দিয়ে যেতে চাই। আমি সাটুরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরেছি। এমনও মানুষ আছে যাদের রাতে ঘুমানোর স্থান নেই। বাঁশঝাড়, গাছতলা আশ্রয় নিয়েছে, কোন রকম ছাপড়া তুলে থাকে পরিবার নিয়ে।
এমন মানুষদের খুঁজে বের করার জন্য আমি চেয়ারম্যানদের বলি, তাদের তালিকা অনুযায়ী ২০-২৫ টি ঘর করে দেই। কিন্ত এতে দেখা গেছে কিছু চেয়ারম্যানদের নিকট মানুষদের ঐ সব ঘরের তালিকা দিতে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই ফেসবুকে আমাদের গ্রুপে এমন অসহায় মানুষদের ঘরের ছবি চাওয়া হয়। আমরা সরেজমিনে ঘুরে তাদের ঘর করে দিচ্ছি। আমি ও আমার “সাটুরিয়া ফার্স্ট”-গ্রুপের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সাটুরিয়া উপজেলায় কোন আশ্রয়বিহীন,ঘরবিহীন পরিবার থাকবে না। এমন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে চলছি।২০ জুলাই পর্যন্ত আমরা ৮০ টি ঘর করে দিয়েছি।
এমন আরো কেউ যদি থাকে আমরা তারও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিব।”

মানিকগঞ্জ২৪/ হা. ফ/ ২২ জুলাই/ ২০১৭।

আরো পড়ুুন