অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম আরজু, ১৩ ডিসেম্বর:
১৯৭১ সালে এই সময়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী পর্যুদস্থ, বিপর্যস্থ হয়ে পলায়নের পথ খুঁজছে। সুবেদার মেজর আ. হক ও হাবিলদার সোনামুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আমাদের মুক্তিবাহিনী ক্রমেই মানিকগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান শক্তিশালী করছে।
পাক বাহিনী শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। শহরের বাইরে গ্ৰামাঞ্চলে বেরুলেই মুক্তি বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পড়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ছে। আমরা শহরের কাছাকাছি থাকায় প্রতিদিন ক্যাম্প বলল করেছি। প্রতি রাতেই আমরা অবস্থান বদল করেছি।
১৩ ডিসেম্বর আমরা মানিকগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী চরমত্ত গ্ৰামের জানু মোল্লার বাড়িতে ছিলাম। ১৪ ই ডিসেম্বর ভোরেই খবর এলো পাক বাহিনী মানিকগঞ্জ ছেড়ে পালিয়েছে। খবরটি নিশ্চিত করতে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলে আমি একটা রিভলবার ও হ্যান্ড গ্ৰানেড নিয়ে বাইসাইকেল করে ধলেশ্বরী ব্রীজ হয়ে থাকা আরিচা রোড ধরে পশ্চিম দিকে চলতে থাকি। বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পিটিআইতে ছিল পাক বাহিনীর ক্যাম্প।
উচুটিয়ায় পাক বাহিনীর বা়ংকার ছিল,পরখ করে দেখলাম রাত্রে কারো চলাচল ছিল না। ঘনকুয়াশার আস্তরন পড়ে আছে। দ্রুত বাসস্ট্যান্ডে পিটিআই ক্যাম্পে ঢুকলাম। সে এক বিভৎস দৃশ্য- ছেড়া খুড়া, গুলিতে ছিন্নভিন্ন নারী দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ছোট ছোট রক্ত, মাংসের দলা, হাড় গুড়, নারী দের পরিধেয় কাপড় চোপড় পড়ে আছে,।
দ্রুত কমান্ডারকে খবর পাঠিয়ে শহরে ঢুকলাম। কালীবাড়িতে সরকারি ট্রেজারি ব্যাংকের সামনে অনেক ভীড়, ব্যাংকের পুলিশ জড়ো হয়েছে তারা চিৎকার করে বলছে আমরা ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর কাছে সারেন্ডার করবো। আমি একহাতে রিভলবার ও হ্যান্ড গ্ৰানেড হাতে উপস্থিত হলে সমবেত জনতা বিশেষ করে অধ্যাপক আলী আহমদ স্যার আমাকে দেখে বললেন এই যে ক্যাপ্টেন হালিমের লোক এসে গেছে, ওর কাছে সারেন্ডার করো।
ইতিমধ্যে সুবেদার মেজর আ. হক এর নেতৃত্বে আমাদের বাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় মানিকগঞ্জ শহরে ঢুকে পড়েছে, ট্রেজারি ব্যাংক যেহেতু সরকারি ব্যাংক, তাই ওটা পাহাড়া দেওয়া ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ওখানে পাহাড়া বসাই। ইতিমধ্যে শহরের লোকজন বের হতে শুরু করেছে,দু-একজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য ঢুকতে শুরু করেছে।
পাক হানাদার মুক্ত মানিকগঞ্জ শহরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিই সবার আগে পিটিআই ক্যাম্প ও শহরে পদার্পণ করেছি, আমার কাছেই ট্রেজারি ব্যাংকের ৩২ জন পুলিশ অস্ত্রসহ সারেন্ডার করেছে, সুবেদার মেজর আ. হক ও হাবিলদার সোনামুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন আমাদের মুক্তি বাহিনীই বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবার আগে মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশ করেছে।
শহরে কোন প্রশাসন ছিল না। লুটপাট চূরি ডাকাতি প্রতিরোধে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহরে রাতে কারফিও জারি করে আমরা ক্যাম্পে ফিরার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ মুজিববাহিনীর সাথে আমাদের সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনা ছিল। আমরা ক্যাপ্টেন হালিমের নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলাম।
১৫ ই ডিসেম্বর আমাদের বাহিনী পর্যুদস্থ ও পলায়নরত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবারিয়া,বাথুলী, কালামপুর এলাকায় সারাদিনব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ঐ যুদ্ধে আমরা আমাদের সাথী, আমাদের অন্যতম কমান্ডার আ. ওহাব কে হারাই। তিনি বাথুলীতে পাকবাহিনীর গুলিতে শহিদ হন।
আমরা ১৬ ডিসেম্বর ব্যান্ডপার্টি ও অস্ত্রশস্ত্র সহ কয়েক হাজার মানুষ নিয়ে বিজয় মিছিল করে ক্যাপ্টেন হালিমের বাসভবনের সামনে সমবেত হই। ক্যাপ্টেন হালিমের নির্দেশে আমাদের বাহিনী মানিকগঞ্জ থানার নিয়ন্ত্রণ নিই ও থানাতেই অবস্থান নিই।
মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদান ও অস্ত্র জমা দানের আগ পর্যন্ত আমরা মানিকগঞ্জ থানাতেই অবস্থান করেছি এবং প্রশাসনিক কাজে সহযোগিতা করেছিল। আমি থানা এবং কোর্ট দারোগার দায়িত্বে থাকা সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরীর সাথে সমন্বয় করেছি। সে সকল দালাল রাজাকার দের ধরে জেলখানায় বন্দী করা হয়েছে তাদের তালিকা করে গাড়িতে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দিয়েছি। এরকম তিন কিস্তিতে আমি দায়িত্ব পালন করেছি।
হানাদার মুক্ত মানিকগঞ্জ শহরে মুক্তিযোদ্ধা দলের অবস্থান ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ে পরবর্তী কিস্তিতে লেখার চেষ্টা করবো।
লেখক : বীরমুক্তযোদ্ধা ও প্রবীণ রাজনীতিক, মানিকগঞ্জ ।
মানিকগঞ্জ২৪/ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০।