মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি, ১৩ ডিসেম্বর :
১৯৭১ সনের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে রাতের আঁধারে মানিকগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী। মুক্ত হয়েছিল মানিকগঞ্জের প্রতিটি জনপদ।লাল-সবুজ পতাকা উড়েছিল মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে।
২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে মানিকগঞ্জ সদর থানার ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর আসে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বিডিআর পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানী ঢাকা বিভিন্নস্থানে নিরিহ, নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রনিয়ে হামলা চালিয়েছে, নির্বিচার গণহত্যায় মেতে উঠেছে।
বিদ্যুৎ গতিতে এ খবর শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লে মানিকগঞ্জের মুক্তিকামী জনতা হানাদার প্রতিরোধ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসে।রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ সমবেত হতে থাকেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) কার্যালয়ের সামনে।
সে সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এসডিও কার্যালয়ে এক জরুরি সভায় বসে সিদ্ধান্ত নেন হানাদার প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার।রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে ঐ সভায় যোগ দিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব এবং সে সময়ের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী।রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
রাতের স্তব্ধতা ভেঙে শ্লোগানে শ্লোগানে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান অপেক্ষমান হাজারও জনতা।ঐ রাতেই ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর আলুর গুদামে বসে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ তৎকালীণ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য খন্দকার মাযহারুল হক চাঁন মিয়ার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ‘বিপ্লবী পরিষদ’।
এই পরিষদের সদস্য হিসেবে ছিলেন আব্দুল হালিম চৌধুরী, জাতীয় পরিষদ সদস্য আক্তার উদ্দিন খান, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সিদ্দিকুর রহমান, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মীর আবুল খায়ের (ঘটু ডাক্তার), ন্যাপ নেতা সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ন্যাপ নেতা খন্দকার দেলোয়ার হোসেন এবং তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা মফিজুল ইসলাম খান কামাল।
২৫ মার্চ রাতেই এই বিপ্লবী পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানিকগঞ্জ মহকুমা ট্রেজারিতে সংরক্ষিত রাইফেল এবং গুলি লুট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রেজারির তালা ভেঙে লুট করা হয় ২৬টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং বিপুল পরিমাণ গুলি।
পুলিশ ওয়ারলেছের মাধ্যমে এবং ম্যাসেঞ্জার পাঠিয়ে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটি কাটাতে আসা সৈনিকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের আহ্বান জানানো হয়।একই সাথে কমান্ড কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কালীগংগা নদীর তরা ফেরিঘাট এবং ধামরাইয়ের নয়ারহাটের বংশী নদীর ফেরিঘাট থেকে ফেরিগুলোকে সরিয়ে ফেলা হয়।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ কেটে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। যাতে হানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হয়।২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর আলুর গুদামে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত কমা- কাউন্সিলের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন।সেদিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিকে শতশত পাকহানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার, জঙ্গি বিমান, কামানসহ সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে মানিকগঞ্জ শহর দখল করে নেয়।শত্রুবাহিনীর শক্তি পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ সমরের পরিবর্তে গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নিতে মানিকগঞ্জ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে অবস্থান নেন।এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি মুক্তিযোদ্ধারা।
৭১ এর নয়টি মাস বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চালিয়ে গেছেন অসংখ্য মরণপণ গেরিলা হামলা, উড়িয়ে দিয়েছেন ব্রিজ-কালভার্ট। মানিকগঞ্জের বচেয়ে বড় যুদ্ধটি হয় ২৯ অক্টোবর।তৎকালীন সিংগাইর থানার গোলাইডাঙা নূরালী গংগা খালের কুম এলাকায়।
ঐদিন হানাদার বাহিনীর কয়েকশ সদস্য নয়টি নৌযানে করে গোলইডাঙা হাইস্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প দখল করতে আসে।হানাদার বাহিনীর আসার সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প খালি করে গেরিলা হামলা চালনোর জন্য নদী তীরের ঝোপঝাড়ে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।পাক বাহিনীর নৌযানগুলো গোলাই ডাঙ্গা স্কুল ক্যাম্পে কোন মুক্তিযোদ্ধাদের না পেয়ে নিশ্চিন্ত মনে ফিড়ে আসতে থাকে।
হানাদার বাহিনীকে বহন করা নৌযানগুলো এ্যাম্বুশে আসা মাত্রই শুরু হয় প্রচন্ড গেরিলা হামলা।মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ আক্রমণে একে একে ডুবে যায় হানাদারদের ছয়টি নৌযান।এ গেরিলা অভিযানে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়ে নিহত হয় ৮১ জন খানসেনা।
মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয় মর্টারসহ বিপুল পরিমাণ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।
গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে পরাজয়ের পর মানিকগঞ্জে অবস্থানরত পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।ফলে নিজেদের ক্যাম্পের বাইরে অভিযান চালানো কার্যত: বন্ধই করে দেয় হানাদাররা।তাই বলে তাদের গণহত্যা তখনও থামেনি।
জেলার বিভিন্ন স্থানে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে চালানো হয় এই নির্মম গণহত্যা।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানিকগঞ্জের সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনাটি ঘটানো হয় ২২ নভেম্বর, ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামে।এই দিনে তেরশ্রী এস্টেটের জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায় চৌধুরী ও অধ্যক্ষ অতিয়ার রহমানসহ ৩৬ জন স্বাধীনতাকামী মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে, বেয়নেট চার্জ ও গুলিকরে হত্যা করা হয়।জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো তেরশ্রী গ্রামটিকে।
ডিসেম্বরের শুরুতেই মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এক এক করে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করতে থাকেন। ১২ ডিসেম্বরেই মানিকগঞ্জ শহরের বড় একটি অংশসহ পুরো মানিকগঞ্জই হানাদারমুক্ত হয়ে যায়।
কিন্তু ঐদিন পর্যন্তও মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের কাছে পিটিআই’র প্রধান ঘাঁটি এবং সদর দপ্তরটিতে অবস্থান করতে থাকে পাকবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সৈনিকেরা। জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা খানসেনারাও এখানে সমবেত হতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে এসে অবস্থান নেন মানিকগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে। সিদ্ধান্ত হয় ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই প্রাইমারি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট (পিটিআই) কমপ্লেক্সে এ স্থাপিত পাকবাহিনীর প্রধান ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেয়ার।মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং গতিবিধি বুঝতে পেরে মধ্যরাতের পর অত্যন্ত সন্তর্পণে মানিকগঞ্জের সদরদপ্তর ছেড়ে পালিয়ে যায় সহস্রাধিক পাকসেনা।
১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। বিজয়ের বাঁধভাঙা আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। মানিকগঞ্জের প্রতিটি জনপদে সগর্বে উড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা।১৪ ডিসেম্বর সকালে দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের পতাকা।
দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে মানিকগঞ্জের ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন, গণহত্যার শিকার হয়েছেন সহস্রাধিক সাধারণ মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম ‘বীর উত্তম’, শহীদ মাহফুজুর রহমান, ইব্রাহিম এবং আতাহার আলী এ তিন সূর্যসন্তানকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
এই দিবটিকে উপলপক্ষে প্রতিবছরের মত এবারও ১৩ ডিসেম্বরে মানিকগঞ্জে মধ্যরাতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি নিয়েছেন।
মানিকগঞ্জ ২৪/ হা.ফ/ ১৩ ডিসেম্বর ২০২০