মেথড-মিথ-ম্যাজিক-মুন্নী

“আমি যখন আজকের কাগজের সম্পাদক, সে তখন নবীন সহ-সম্পাদক। সেই সহ-সম্পাদক সংবাদপত্র ছাড়িয়ে একটি নিউজ টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক। আমার মতো, অনেক বছর আগের গুরুকে ছাড়িয়ে সে এখন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়, উজ্জ্বলতায়।” আমাদের নতুন সময় পত্রিকার প্রথম পাতায় এরকম একটা নোট পড়ে আজকের সকাল শুরু। মূল ধারার গণমাধ্যমে কাজ করার এই ত্রিশ বছর পর অফিসিয়ালি মুন্নীদির নিজের পজিশন কিংবা চেয়ারের নাম প্রধান নির্বাহী সম্পাদক। নাঈমুল ইসলামের খানের কয়েক শব্দেই একজন মুন্নী সাহার সংবাদ-জীবন-জার্নি স্পষ্ট। এই অর্জন- ‘অর্জন’ করতে যে দম লাগে সেই দমের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারাই বুঝবেন। এখানে এই আলোচনা থাক। বরং একজন বিব্রত ডাক্তারের কথা বলি। তিনি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। ‘ভাই’ সম্বোধন করি। অস্বস্তিতে ভুগছেন কারণ- তিনি ভাবতে পারেননি মুন্নী সাহা তাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করবেন। একটা ধারণা পোষন করতেন যে- মুন্নী সাহা মানে একটা অহংকারী পাওয়ারফুল মিডিয়া পার্সোনালিটি। তাঁকে সবাই ফেইস করার সাহস পায় না ইত্যাদি। সেই মানুষটা যখন একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে, অফ এয়ার-অন এয়ারে বিনয়ের সাথে স্যার সম্বোধন করছিলেন তখন মনে মনে নিজের এত বছরের পুষে রাখা ধারণার সঙ্গে বোঝাপড়া করছিলেন। ভাবছিলেন, ”তাহলে কী এতোদিন আমি ভুলের মধ্যে ছিলাম?”

ভুলের মাঝে থাকি আমরাও, যারা তাঁর কাছ থেকে বেশি স্নেহ আর পাত্তা পাবার প্রতিযোগিতা করি। আমাদের এই থাকাটা একটু অন্যরকম।

মনে মনে বিভ্রান্তি ফেরি করার মতো। ভাবি- ‘দিদি আমার উপর খ্যাপা নাতো?’ আগের মতো স্নেহ করে? দেখা হলে কথাই বলে না, পাশ কেটে চলে যায়। কিন্তু আমরা একসময় বুঝতে পারি ঠিকই- এই না বলার মধ্য দিয়ে কিছু একটা বলে যাবার নামই মুন্নী সাহা। অনেকটা Hypnotical player. ব্রেইনের সাথে যে খেলতে জানে। আর এভাবেই দিদির সঙ্গে আমার-আমাদের বোঝাপড়াটা হয়, মনে মনে, তলে তলে, ভালোবাসায়, স্নেহের প্রশ্রয়ে, ধমকের বলয়ে।

আমার ধারণা- আমাদের সকলের নামে দিদির কাছে একটা করে ফাইল আছে। মাথায়। কে কী করে, কেন করে, কীভাবে করে, কেন করে না, কার কী চাওয়া, কার কী পাওয়া ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় সেখানে। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ কোনও না কোনও অভিমান, অভিযোগ, চাওয়া, দাবির দরখাস্ত করি। কিন্তু কখনো ভেবে দেখি না- দুনিয়ার সব আবদার অভিযোগ অভিমান চাওয়া পাওয়া, পাত্তা বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা করি যার কাছে, তারওতো মন আছে। সেও বিপদগ্রস্ত হয়, বিপন্ন বোধ করে। ভিতরে কুকড়ে যায়। সময়ের বীভৎস বোঝা তাকেও আক্রান্ত করে। তাঁরও শ্বাস ফেলার খোলা মাঠের দরকার হয়। তাঁরও একটা ভরসা কিংবা নির্ভরতার দরকার হয়। তখন সে কার কাছে যায়?

আমার কাছে সফল মানুষের উদাহরণ মুন্নী সাহা। এই সাফল্য কী শুধু ক্যারিয়ারের দিক থেকে? না। এটা নিজেকে একটা নির্দিষ্ট জার্নির মধ্যে ফোকাসড রাখতে পারার সাফল্য। আজকাল আমরা মন ও মনোযোগকে এত ভাবে ভাগ করে রাখি যে- ঠিক কোন কাজটা আমার করার দরকার, সেটা ভুলে যাই। ফলে অসংখ্য পরিচয়ের মধ্যে ডুবে থাকার মধ্যে নিজেকে পরিচয়হীন করে তুলি, যা তিনি করেননি। সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু, সাংবাদিকতায় নিজেকে গড়েছেন, ভেঙেছেন, পায়ের তলার মাটি শক্ত রেখে। এখানে থেমে গেলেও তাঁর নামকে কোটি মানুষ মনে রাখবে। কিন্তু তিনিতো থেমে যাওয়ার মানুষ নন। করোনায় আক্রান্ত হয়েও মাথায় নিউজ আর শো, প্ল্যানিং, নতুন নতুন আইডিয়া জারি রেখেছেন। মাথাকে অবিরাম কাজে রাখার এই শক্তি তাঁর ভিতরের শক্তি। জীবনকে কাজের ভিতর দিয়ে রচনা করার স্পৃহা দেখার মতো। দেখি।

আরও দেখি যে- একটা বাউল মন আছে। যে মনে হাওরের বাতাস খেলা করে। লালনের সহজ মানুষ ঘোরাফেরা করে। যে মন কোথায় যেনো হারিয়ে যেতে চায়, কোথায় যেনো। এদিক সেদিক, নিউজ ও অনুষ্ঠানের ওপর ভর করে তিনি ঘুরেন। ঘুরে তাঁর বাউলমন। কীসের যেনো সন্ধান করে। দুবছর আগে এক জেলা জজ বড় বোন- খাবার টেবিলে বলেছিলেন- “তোদের মুন্নীতো একটা বাউলরে। না হলে কেউ এভাবে সারাদেশে ঘুরে বেড়ায়। গান গায়, নাচে।” মনে মনে বলি, আপনি একটি কোর্টের সর্বোচ্চ বিচারক, আপনার বিচারতো ভুল হবার কথা না।

আমি টের পাই- দিদির মাথায় ও মনে একটা সিস্টেম জারি আছে। কন্টিনিউয়াস লার্নিং এর সিস্টেম, ইনফরমেশন আহরণের সিস্টেম, জ্ঞান অর্জনের সিস্টেম। তিনি ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছেন যে- যার কাছে যত বেশি তথ্য আর তত্ত্ব থাকবে, সেই তত বেশি দিক থেকে দেখতে পাবে জীবন ও জগতের তাবত কেরামতি। মাঝে মাঝে এমন কিছু বইয়ের সন্ধান চান, আমি হিসাব মেলাতে পারি না। এত ব্যস্ততার ভিড়েও নিজের ক্ষুধাকে জাগ্রত রাখার শক্তি তাঁর ঈর্ষনীয়। আর সেটা শুধু যে বই থেকে, তা নয়। বন্ধু থেকেও। তাঁর নানান রঙের নানান বর্ণের, নানার রুচির, নানান বোধের বন্ধু আছে। মনখারাপের দিনে যারা তাকে বনস্পতির ছায়া দেয়। একেকটা বন্ধু একেকটা জানালা যেনো। কোনও কোনও জানালা থেকে গান ভেসে আসে, কোনও জানালায় কবিতা, কোনও জানালায় দর্শন আবার কোনও জানালায় লালন ফকিরের ভাবদরিয়া, ‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’। আর এইভাবেই, ঘরে-বাইরে, অফিসে, শত শত মুখ, মুখোশ, নিজের মনে জমে থাকা ভাবনারাশি, জীবন জিজ্ঞাসা, দ্বন্দ্ব আর সবতোলপাড় মোকাবেলা করতে করতে খুব কৌশলে নিজের একান্ত বোধের জীবনটাও যাপন করতে পারছেন যে শক্তি দিয়ে সেই শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা। শুভ জন্মদিন Munni দি। জ্বলে থাকুন আপন শক্তিতে।

সাংবাদিক সেজুল হোসেন এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া।

মানিকগঞ্জ২৪/ ২ অক্টোবর ২০২০।

 

আরো পড়ুুন