মানুষ আসলে পাখি

সাইফুদ্দিন আহম্মেদ নান্নু, ২০ জুলাই:

৫৮টি বছর,অনেক দিন,অনেকগুলো দিন। আমার এই দীর্ঘ জীবনে কত আপন মানুষ হারিয়ে গেছে,চলে গেছেন না ফেরার দেশে।  বাবা মা চলে গেছেন দুই যুগ আগে। শৈশবের খেলার সাথী,স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠীদের অনেকেই আজ নেই ।

আমাদের বাড়ির সামনের খরস্রোতা খালে তখনও পাকা ব্রিজ হয়নি। খেয়া নৌকায় এপার-ওপার যেতাম, কখনোবা এমনিতেই বসে থাকতাম। কতশত মানুষ আসতো যেতো, দেখতাম। সেইসব অচেনা মানুষেরা হয়তো কেউ আর নেই। নিমাই কাকু সেই খেয়ানায়ের মাঝি ছিলেন। লম্বা বাবড়ি চুল ছিল, সে চুলে খোপাও বাঁধতেন মাঝে মাঝে । সেই নিমাই কাকু নেই।

ক্লাস টু-থ্রিতে পড়াতেন লম্বা একহারা গড়নের পারুল দিদিমনি। চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি পড়তেন। মিস্টি সুবাস ছড়ানো জর্দায় পান চিবুতেন। ক্লাসে ঢুকতেন বেত হাতে। সেই পারুল দিদিমনির পা পিছলে একবার পা ভাঙলো,আমাদের সেকি আনন্দ! পারুল দিদি ক্লাসে আসবেন না ভেবে। আমরা যখন বড়, একদিন শুনলাম আমাদের পারুল দিদিমনি মরে গেছেন, সেদিন কেন যে কেঁদেছিলাম জানি না।

পিতার মত বিশাল হৃদয়ের শিক্ষক হেদায়েত স্যার, রুদ্রবাবু স্যার, নিয়ামত স্যার,যোগেশ স্যার,রাজা স্যার,এয়াকুব স্যার,তেজারুদ্দিন, শামসুল হক স্যারেরা কেউ নেই।

ইন্টারস্কুল স্পোর্টস সামনে,স্কুল মাঠে প্রাকটিস চলছে ধুমছে। কেউ চাকতি ছুঁড়ছে,কেউ গোলক,কেউ নিক্ষেপ করছে বর্শা।  কে যে ছুঁড়েছিল মনে নেই। পিছন থেকে ছোঁড়া বর্শা স্কুলের দপ্তরি মজু ভাইয়ের লুঙ্গি ভেদ করে দুই পায়ের মাঝ দিয়ে হাঁটু বরাবর মাটিতে গেঁথে গেল। মজু ভাই বর্শা ছাড়িয়ে বললেন,”আমি আর চাকরি করুম না।” হেড স্যার হাতে পায়ে ধরে তাঁকে শান্ত করলেন। আমরা মাঠ ফাঁক করে ভোঁ দৌড়ে পালিয়েছিলাম। সেই মজু ভাইও নেই।

পাশের বাড়ির জিন্নত কাকা, বাবার কলিগ ছিলেন। মানিকগঞ্জের পত্রিকার প্রথম এজেন্সিও ছিল তাঁর। তিনি আমাকে ধরে ধরে সেই শিশুকালে পত্রিকা পড়া শিখিয়েছেন। প্রথম পাতার জাম্প নিউজ ভিতরের পাতায় কেমন করে খুঁজতে হয় বুঝিয়েছেন। প্রতিদিন দশপনেরটি পত্রিকা আমার হাতে গুঁজে দিতেন, কেবল বলতেন “পড়া শেষ হলে দিয়ে যেও।”পত্রিকা পড়ার সেই নেশা আজও আছে কিন্তু জিন্নত কাকা নেই।

বাড়ির পিছনে বিশাল পুকুর ছিল, সেই পুকুরে মাঘের শীতে প্রায়ই ডুবে ডুবে হৈচৈ বাঁধাতো চিমটা হাতের জটাধারী “কুকপাগলা”। সবাই টেনেটুনে পাড়ে তুলে আগুন জ্বালিয়ে তাকে সুস্থ্য করতো। এমনিতে ভীষণ ভয় পেতাম তাকে দেখলে। কিন্তু শীতজলে বিপন্ন পাগলাকে পরম কৌতুহলে কাছে বসে দেখার মজাটা ছিল অন্যরকম। সেই ভয়জাগানিয়া পাগলটিও নেই।

বাড়ির আঙিনায় বাবার হাতে বোনা আম গাছে মা সাঁচিপানের গাছ তুলেছিলেন,সেই আমগাছ,মায়ের সাঁচি পান কোথায় সব হারিয়ে গেছে জানি না।
বড় ঘরের পিছনে ছিল বিরাট মুরগীর খোপ। মা ছিলেন তার মালিককাম কেয়ার টেকার। প্রতিদিন ভোরে মা যখন সেই খোপের দরজা খুলতেন তখন বাড়ি মাতিয়ে চিৎকার করে আমাদের ঘুম নষ্ট করতো মুরগীর পাল। মাটির সানকিতে করে মা যখন ওদের খাওয়াতেন তখন মনে ঈর্ষা হত। মনে হত ওরা যেন আমাদের সৎ ভাইবোনের দল।

কত রাত জানালায় চোখ রেখে টর্চ হাতে মায়ের সাথে খোপ পাহারা দিয়েছি। শেয়াল, খাটাশ,বাঘডাস এমনকি মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে হইচই করে চোরও তাড়িয়েছি। কোথায় কখন হারিয়েছে সেই মুরগীর দল, তার খোপ,মনে নেই।

মানুষ আসলে পাখি, আকাশ ছেয়ে চারপাশ মুগ্ধ করে উড়ে। আবার উড়ে উড়ে নীল দিগন্তে টুপ করে হারিয়ে যায়,আর ফিরে আসে না।

ফিরে না আসা পাখিদের জন্য মনটা বড় কাঁদে। তাকিয়ে থাকি শূন্য সে আকাশ পানে,পথটা বড্ড চেনা,ঐ চেনা পথে একদিন টুপ করে আর সব পাখিদের মত আমিও উড়ে যাবো।  আর ফেরা হবে না কোন দিন এই চেনা মাঠে,ঘাটে,চায়ের আড্ডায়।

আমার উঠানে, জানালার পাশে, জামরুল আর লেবুর বাগান নিঃসঙ্গ পড়ে রবে কিছু দিন। তারপর সেই লেবুর বাগান, জামরুল গাছেরাও কোন এক বিষন্ন বিকেলে পাখি হয়ে উড়ে যাবে।

লেখা ও ছবি সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহম্মেদ নান্নু এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।

মানিকগঞ্জ২৪/ ২০ জুলাই ২০২০।

আরো পড়ুুন