সাটুরিয়া প্রতিনিধি, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলা সহাকারী কমিশনার (ভ‚মি) অফিস যেন ভোগান্তীর অপর নাম। বাড়তি টাকা দিলে স্বস্তিতে মিলে নানা গ্রাহক সেবা। নামজারি, মিসকেসসহ বিভিন্ন সেবার জন্য বাড়তি টাকা দিলেই ২০-৩০ দিনের মধ্যেই মিলে সেবা। আর টাকা না পেলে বছরের পর বছর ঘুরেও পাচ্ছেন না গ্রাহক সেবা।
সাটুরিয়া উপজেলা ভ‚মি অফিসে বুধবার সকাল থেকে অবস্থান করেন বিভিন্ন স্থানীয় গণ মাধ্যমকর্মীরা। প্রতি বুধবার বিভিন্ন শুনানির দিন ধার্য করা হয়। সকাল থেকেই ভ‚মি অফিসের গোল চত্তর ও অফিস আঙ্গিনায় শত শত মানুষের জটলা। অপেক্ষা করছেন কখন কাদের শুনানির জন্য ডাক আসে। কিন্তু অভিযোগ আছে, সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভ‚মি) তানভীর আহমদ অফিসে এসে চা, নাস্তা খাওয়ার নামে ঘন্টার পর ঘন্টা রুমে বসে থাকেন। তার দপ্তরে যেতে হলে, গ্রাহকের ১ থেকে ২ ঘন্টা বাহিরে অপেক্ষা করতে হয়।
দুপুর ১২ টার দিকে তার দপ্তরে গিয়ে জানতে চাইলে ২৩ এপ্রিল কয়টা শুনানির জন্য রাখা হয়েছে। এর উত্তরে সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভ‚মি) তানভীর আহমদ বলেন, আজকে ২৫ টা শুনানির মধ্যে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ৫ টি শুনানী।
খোজ নিয়ে জানাগেছে, এ অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এমনকি সহকারী কমিশনার (ভ‚মির) যানবহান চালকের সাথে একটি শক্তিশালী দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। নামজারীর ডিসি আর কাটতে সরকারী ফিস লাগে মাত্র ১১০০ টাকা। কিন্তু কোন ঝামেলা ছাড়া নামজারী বা জমির খারিজ করতে দালালের মাধ্যমে প্রতিটির জন্য ১০- ১৫ হাজার টাকা নিচ্ছে। আবার কোন ওয়ারিশ কিংবা রেকডমূলে ঝামেলা থাকলে প্রতি শতাংশ জমির জন্য ১- ২ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ নিচ্ছে। দালাল ছাড়া নামজারি/ খারিজের জন্য অনলাইনে আবেদন করলে, সেটা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার নিকট তদন্ত শেষে আসে উপজেলা ভ‚মি অফিসে। কিছুদিন পর কোন দালালের মাধ্যমে তদবির না করলে সেটা কোন কারন দেখিয়ে খারিজ আবেদন বাতিল করে দেন সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) তানভীর আহমদ। আর টাকা নিদির্ষ্ট সিন্ডিকেট বা দালালের মাধ্যমে বাড়তি টাকা দিলেই আবেদনের ২৮ দিনের মধ্যেই নামজারি হয়ে যাচ্ছে।
বুধবার সাটুরিয়া ভ‚মি অফিসে আসা দরগ্রাম ইউনিয়নের আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি ১৫ বছর আগে একটি জমি ক্রয় করছি। যার নিকট থেকে ক্রয় করেছি তার নামে খারিজ করা । পরে আমার নামেও খারিজ করেছি। কিন্তু আমার খারিজের বিরুদ্ধে আরেকজন ঢাকা দিয়ে মিসকেস করেছে। আমাকে ৩ বছর ধরে শুনানিতে অংশ নিলেও আমাকে মুক্তি দিচ্ছে না।
ফুকুরহাটি ইউনিয়নের আব্দুস সামাদ সামু বলেন, আমি যার নিকট জমি কিনেছি, আর, এস রেকর্ড এ তার নাম নাই। এ নিয়ে মানিকগঞ্জের জজ কোর্টে মামলা করি। এতে আমি রাই পাই। এর মধ্যে আমার কেনা জমি আরেকজনের নামে খারিজ করে দিয়েছে। এখন আমি ঐ ভ‚য়া খারিজের নামে মিসকেস আবেদন করি ১০ মাস আগে। এখন আমার মিস কেস নিয়ে শুধু টালবাহানা করছে।
বালিয়াটি ইউনিয়নের গর্জনা গ্রামের ইমারত হোসেন বলেন, আমি জমি কিনি ১৪ শতাংশ দুই দাগ থেকে। জমির পূর্বে মালিকের আলকাছ আলী মালিক হচ্ছে ৯ শতাংশ। কিন্তু খারিজ করে নিছে ১২ শতাংশ। এখন আমি অনলাইনে নামজারি আবেদন করতে গেলে অনলাইনে আবেদন নিচ্ছে না। জমির দলিল আছে, পর্চা আছে কিন্তু আমি জমির খারিজের জন্য আবেদন করতে পারছি না। আমার প্রশ্ন হল রেকর্ড মূলে মালিক ৯ শতাংশ তাকে কিভাবে ১২ শতাংশ জমি খারিজ দিল ।
শুনানিতে আসা গর্জনা গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, গর্জনা মৌজার পৈত্বিক সূত্রে জমির মালিক হচ্ছি ৯.৭৫ শতাংশ। অনলাইনে আবেদন করি তাই। কিন্তু খারিজ করার পর দেখি ১৩ শতাংশ। আমি আমার ওয়ারিশদের ঠকাব না। আমি এখন উল্টা মিসকেসের আবেদন করছি বাকী জমি ফেরত দিয়ে সংশোধন করার জন্য। ঢাকায় একটি অফিসে জব করি। দিনের পর দিন ঢাকা থেকে সাটুরিয়ায় আসতে ভাল লাগে না।
পূর্ব কুষ্টিয়া গ্রামের ও একই মৌজার মিস কেস নং ৭৬/২৩-২৪ বিবাদী শুকুর আলী বলেন, আমার কোর্ট থেকে রায় আছে, নাম জারি করা আছে। তারপরও সাহিদা আক্তার নামে মিসকেসের আবেদন করেছেন। সেটা আমালে নিয়ে সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) আমলে নিয়েছেন। দলিল সহ বিভিন্ন প্রমাণ থাকার পরও আমাকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে না। টাকা ছাড়া ত এমন হয়রানি করার কথা না।
ফুকুরহাটি ইউনিয়নের সেক রহম আলী ওরফে আঃ রহমান বলেন, আমি ১৯৭৩ সনে পোনে ১০ শতাংশ জমি কিনি। নানা কারনে আমি এতদিন খারিজ করতে পারি নাই। এখন জানতে পারলাম আমার জমি আরেকজন খারিজের আবেদন করেছে। যার আবেদন নাম্বার ১১৬১৭৯৩০, ৪৪২৭/২৪-২৫ এর বিরুদ্ধে আমি একটি লিখিত অভিযোগ দিয়ে অনুমোদন না দেওয়ার জন্য আবেদন করি ০৭-০৪-২০২৫ তারিখে। উপজোলা ভ‚মি অফিসে আইসা তার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) সাথে দেখা করতে গেলে ঘন্টা পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। তারপরও প্রবেশ করছি। আমার সকল কাগজ এ মাসে ৩-৪ বার দেখা কইরা কোন কাজ হয় নাই। আমার পতিপক্ষ মোটা অংকের টাকা দিয়ে খারিজ করে নিবে আমাকে হুমকি দি”েচ্ছ। পরে সাংবাদিকদের অবস্থান দেখে, আজকে আমাকে বলছে , বিষয়টি দেখে আবেদন বাতিল করব।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সাটুরিয়া উপজেলা ভ‚মি অফিসে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ভ‚মি অফিসের যে কোন সেবা নিতে গেলে হয়রানি করা হয়। পরে দালালের মাধ্যমে গেলে তা নিদির্ষ্ট সময়ের আগেই করে দেওয়া হয়। প্রথমে যে কোন কম্পিউটার দোকন থেকে জমির খারিজের আবেদন করা হয়। সেটা দালাল ইউনিয়ন ভ‚মি সহকারী কর্মকর্তাকে দিয়ে অনুমোদন করে উপজেলায় নিয়ে আসেন। কিন্তু টাকা লেনদেন হয় গোপনে। টাকা পরিশোধ হয়ে গেলে আবেদন নাম্বার লিখে রাখা হয়। সেটি সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভ‚মি) তানভীর আহমদের নিকট অফিসের ষ্টাফ সরবরাহ করলে তিনি খারিজের চ‚রান্ত অনুমোদন করে দেন। এমনভাবে এ অফিসের সকল কাজ এখন দালালের মাধ্যমেই সম্পাদন করা হচ্ছে।
সাটুরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার ( ভ‚মি) তানভীর আহমদ বলেন, তদন্তের সার্থে মিস কেসের রায় ধীরে দেই। দ্রæত করলে ভ‚ল হলে গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে হয়রানি হওয়ার আশংকা থাকে। টাকা ছাড়া নামজারি হয় না , এ বিষয়ে তিনি আরো বলেন, সংবাদকর্মীরা সহযোগীতা করলে তদন্ত করে ব্যাবস্থা দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
তবে সাটুরিয়ার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) অফিসে প্রয়োজনে দুদকের অভিযান চান অনেক ভুক্তভোগী। শুধু কর্মকর্তাদের আশ্বাসের বাণী নয়। দালাল ও সিন্ডিকেট মুক্ত অনলাইনেই সকল নাগরিক সুবিদা পাবে সাটুরিয়া বাসী এমটাই চাওয়া লাখো মানুষের।
মানিকগঞ্জ২৪/ হা.ফ/ ২৩ এপ্রিল ২০২৫।