সাইফুদ্দিন আহম্মেদ নান্নু, ১ জুলাই.
নান্নু ভাই আপনি কোথায় ? এই “কোথায়” শব্দটি শুনলেই বুঝে নিতাম রবি এখন মানিকগঞ্জ শহরে। সময় নিতাম না,পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই দেখা হত দুজনের। অনেকদিন এমনি করেই একসাথে বসেছি দুজন।
রবির সাথে দেখা শেষে খালি হাতে ফিরে আসতে পারিনি কোনদিন । হয় ছোট্ট এক প্যাকেট মিস্টি,নয়তো লিচু,নয়তো আম,নয়তো একমুঠো চকলেট । কিছুনা কিছু হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো,‘মেয়ের জন্যে’।
বছর পাঁচেক আগের ডিসেম্বর। সন্ধ্যার ঠিক আগে রবির ফোন “নান্নু ভাই আপনি কোথায়?”। বললাম,বাসায়। একটু বাইরে আসেন। বাইরে এলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে আমার হাতে তুলে দিল বিজয়মেলা থেকে আমার মেয়ের জন্য কেনা মাটির ফলে সাজানো বাঁশের ছোট্ট ঝুঁড়ি। সন্ধ্যা হয়েছে, আর ভাড়ার গাড়ি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হবে বলে নামবে না। বহু চেষ্টা করেও গাড়ি থেকে সেদিন নামাতে পারিনি রবি,রবির বউ,ছেলে, কাউকে।
শেষ দেখা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের অল্প কদিন আগে কালীবাড়ির মিস্টির দোকান ‘ফেলাদা’য়।
মিস্টিতে খুব একটা ঝোঁক ছিল না তার। তবুও সেদিন ধরে-বেঁধে ফেলাদার রসমালাইয়ে কেটেছিল অল্প কিছুক্ষণ। তাঁর তাড়া ছিল বাড়ি যাবার। যাবার আগে পাশে নামানো ব্যাগ থেকে লিচুর একটি প্যাকেট টেবিলে নামিয়ে বলেছিল,মেয়েকে দিয়েন। সেই শেষ দেখা,শেষ যাওয়া, সামনাসামনি শেষ কথা ।
মানিকগঞ্জের ছেলে হলেও রবিউলের সাথে প্রথম পরিচয় ফেসবুকের সূত্রে। ও তখন সম্ভবত চট্টগ্রামে। রবিউল মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তি,নদী আর প্রকৃতির ছবির পাগল ছিল। সংগ্রহ করতো মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তি, প্রাচীন স্থাপনার ছবি,তথ্য। আমার পোস্ট করা ছবিতে বিস্তারিত তথ্য না থাকলেই ফোন দিত,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতো। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “বই লিখবে নাকি, লক্ষ্মণতো ভাল না! ” উত্তর না দিয়ে অনেকক্ষণ হেসেছিল রবি। ফেসবুক থেকে পরিচয় তারপর বাস্তবে,বয়সের ব্যবধান ডিঙিয়ে বন্ধুত্বে। ভালবাসা,স্নেহ আর শ্রদ্ধায়পূর্ণ বন্ধুত্ব।
১ জুলাই ২০১৬ । সারারাত টিভির সামনে বসেছিলাম। দেখছিলাম হলি আর্টিজানের লাইভ টেলিকাস্ট। শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিটি সেকেন্ড।
পিসিতে খোলা ছিল ফেসবুক। দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন শুনেছি কিন্তু পরিচয় তখনও জানা ছিল না। ঠিক তখনই আমাদের মানিকগঞ্জের সন্তান,মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র সাংবাদিক, ছোটভাই নূর সিদ্দিকীর ফেসবুকে চারপাঁচ শব্দের ছোট্ট একটি স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসটি সম্ভবত ছিল,“ ‘রবি কামরুল’ নামটি আমিই রেখেছিলাম”।
রবির বড়ভাইতুল্য বন্ধু নূরের কথার অর্থ প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি। একটু পরই অজানা শংকায় হিমশীতল কৃষ্ণপাথরের ভার নেমে এলো,যখন মনে পরলো রবিউলের ফেসবুক আইডি,“রবি কামরুল”। দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর আগেই নূরের আরও একটি স্ট্যাটাস,“রবিউল নেই”। নিহত দু পুলিশ কর্মকর্তার একজন আমাদের মানিকগঞ্জের সূর্যসন্তান রবিউল করিম,আমার ছোটভাইতুল্য বন্ধু রবিউল,ফেসবুকবন্ধু ‘রবি কামরুল’।
স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম,মনে পড়লো মেয়ের পড়ার টেবিলে রাখা রবিউলের দেয়া মাটির ফলে সাজানো বাঁশের ছোট্ট ঝুঁড়ির কথা । যন্ত্রচালিতের মত টেবিলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, তাকিয়েছিলাম সেই বাঁশের ঝুঁড়ির দিকে।
একটি ছোট্ট উপহার কত অনায়াসে বদলে গেল অমূল্যস্মৃতিতে,বেদনার পাথরে।
রবি তুমি যেখানেই থাক,ভাল থাকবে জানি। তোমার মত মানুষকে পরমকরুনাময় ভাল না রেখে পারেন না ।
রবি,তোমার গ্রামের অসংখ্য মানুষ আজও তোমাকে স্মরণ করে কাঁদে,গর্ব করে। অন্তর থেকে কাঁদে,অন্তরের গভীর থেকেই গর্ব করে। তোমার হাতে গড়া স্কুলটি আজও তোমার অপেক্ষায় থাকে।
যতদিন বেঁচে আছি রবি তোমাকে মনে থাকবে। কেবল দুঃখ রইল ফোন করে তোমার মত করে কেউ আর বলবে না,“ নান্নু ভাই আপনি কোথায়?” ।
মৃত্যুদিনে প্রার্থনা রইল,তোমার রক্ত,জীবনদান,জঙ্গীবাদের বীজ থেকে শ্যামলমাটির বাংলাদেশকে রক্ষা করুক।
ছবি ও লেখা সাংবাদিক সাইফুদ্দিন আহম্মেদ নান্নু এর ফেসবুক থেকে নেওয়া।
মানিকগঞ্জ২৪/১ জুলাই ২০২০।